এ তো পাপ, লিও। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি চরম অপমান। কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে তোমাকে এর জন্যে। হয়তো যাকে চাও তার সাথে চিরবিচ্ছেদেই রূপ পাবে সে শাস্তি।
যে মানুষ শাস্তিঘরে নির্যাতন সইছে সে কোনো ফাঁকে একটা ছুরি যোগাড় করে যদি আত্মহত্যা করে তাহলে কি তার পাপ হবে, হোরেস? হয়তো হবে, কিন্তু সে পাপ, আমি মনে করি ক্ষমা-ও পাবে। আমি তেমনই এক মানুষ। ঐ ছুরিটা আমি ব্যবহার করবো। এ যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করবো। ও মরে গেছে। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে আমি ওর কাছাকাছি হবো।
কেন, লিও? আয়শা হয়তো বেঁচে আছে।
না। তাই যদি হতো কোনো না কোনো ভাবে ও আমাকে জানাতে সে কথা—কোনো সংকেত বা দৈববাণী। না, হোরেস, আমি মনস্থির করে ফেলেছি, এ নিয়ে আর কিছু বোলো না আমাকে।
আরও কিছুক্ষণ আমি যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। অনেক দিন ধরে যা আশঙ্কা করছিলাম তা-ই ঘটেছে। পাগল হয়ে গেছে লিও। অবশেষে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম আমি।
লিও, আমাকে একা ফেলে রেখে যাবে এখানে? এতটা নির্দয় হতে পারবে তুমি? তোমাকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছি, গায়ে একটা আঁচড় লাগতে দেইনি, তার প্রতিদান দেবে এভাবে? বুড়ো বয়েসে আমাকে একা ফেলে চলে যাবে! বেশ, তোমার যদি তা-ই ইচ্ছা, যাও। কিন্তু মনে রেখো, আমার রক্ত ঝরবে তোমার মাথায়।
তোমার রক্ত! কেন, রক্ত কেন, হোরেস?
যে পথে তুমি যেতে চাইছো সেটা যথেষ্ট চওড়া। দুজন অনায়াসে যেতে পারবো ঐ পথ দিয়ে। অনেকগুলো বছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি, একসঙ্গে অনেক কষ্ট সয়েছি, এখন ইচ্ছে করলেই কি আলাদা হতে পারবো? আমার মনে হয় না।
মুহূর্তে উল্টে গেল দাবার ছক। এবার অর্জিাকৈ নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলো লিও।
আমি শুধু বললাম, তুমি যদি মূয়া, আমি বলছি, আমিও মরবো। তোমার মৃত্যু আমি সইতে পারবো না। সে
হাল ছেড়ে দিল লিও। বেশ, বললো ও, আমি কথা দিচ্ছি, আজ রাতে অমন কিছু ঘটবে না। চলো, জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিই আমরা।
ভয়ে ভয়ে সে রাতে বিছানায় গেলাম আমি। জানি, একবার যখন আত্মহননের ইচ্ছা জেগেছে, খুব বেশিদিন এ-থেকে নিবৃত্ত রাখা যাবে না লিওকে। ওর এই ইচ্ছা ক্রমশ দুর্দম হতে থাকবে। শেষকালে একদিন হয়তো সত্যিই নিজেকে শেষ করে ফেলবে ও।
ও আয়শা! বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকুল কণ্ঠে চেঁচালাম আমি, তোমার যদি সে ক্ষমতা থাকে, দয়া করে প্রমাণ দাও এখনও তুমি জীবিত। তোমার প্রেমিককে বাঁচাও এই পাপ থেকে। তোমার আশ্বাসবাণী না পেলে বাঁচতে পারবে না লিও। আর ওকে ছাড়া আমিও বাঁচবো না।
তারপর ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
.
লিওর কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল আমার।
হোরেস! ফিসফিসে উত্তেজিত গলায় ওকে বলতে শুনলাম, হোরেস, বন্ধু, বাবা, ওঠো তাড়াতাড়ি!
মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে গেলাম আমি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে!
দাঁড়াও আলো জ্বালি আগে, আমি বললাম।
আলো লাগবে না, হোরেস, অন্ধকারই ভালো। একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখেছি, এমন জীবন্ত স্বপ্ন আর কখনও আমি দেখিনি। এক মুহূর্ত থামলো লিও। তারপর বলে চললো, দেখলাম, আকাশের বিশাল কালো ছাদের নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে অন্ধকার। আকাশে একটা তারাও নেই। গভীর, শূন্য এক অনুভূতি গ্রাস করেছে আমাকে। তারপর হঠাৎ অনেক উঁচুতে, অনেক দূরে ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠলো। মনে হলো, আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে একটা তারার আবির্ভাব হয়েছে। ভাসমান আগুনের কণার মতো ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলো আলোটা। নামতে নামতে আমার মাথার ঠিক ওপরে চলে এলো। দেখলাম লকলকে আগুনের শিখা একটা। মানুষের জিভের মতো দেখতে। আমার মাথার উচ্চতায় স্থির হলো ওটা। তারপর, হোরেস, আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওটার নিচে একটা অস্পষ্ট নারীমূর্তি। আলোটা তার কপালে স্থির হয়ে আছে!
বললে বিশ্বাস করবে, হোরেস, মূর্তিটা আয়শার? হ্যাঁ, আয়শার, হোরেস, ওর চোখ, ওর অপূর্ব সুন্দর মুখ, মেঘের মতো এলো চুল সব আমি স্পষ্ট দেখেছি। বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো আয়শা। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ও যেন বলতে চাইছিলো, কেন সন্দেহ কর?
কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার ঠোঁট, জিভ নড়তে চাইলো না। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম ওকে, নাড়াতে পারলাম না হাত-পা। অদৃশ্য এক দেয়াল যেন মাথা তুলেছে আমাদের মাঝখানে। হাত উঁচু করে ইশারা করলো ও, যেন পেছন পেছন যেতে বলছে আমাকে।
এরপর বাতাসে ভেসে চলে গেল আয়শা। ওহ্, আমার তখনকার অনুভূতি যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম, হোরেস! মনে হলো, আমার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এসে অনুসরণ করছে ওকে। বাতাসের বেগে পুবদিকে ধেয়ে চললাম। সাগর, পাহাড় পেরিয়ে। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। এক জায়গায় এসে থামলো ও। নিচে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের রুপালি আলোয় চক চক করছে কোর-এর ধসে পড়া প্রাসাদগুলো। তার ওপাশে, খুব বেশি দূরে নয়, সেই উপসাগর, যেখান দিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম ওখানে।
বিস্তৃত জলাভূমির ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ইথিওপিয়ানের মাথার ওপর থামলাম আমরা। চারপাশে তাকাতে দেখলাম ডাউ-এর সঙ্গে সাগরে তলিয়ে গিয়েছিলো যে আরবগুলো তাদের মুখ। আকুতিভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। জবকেও দেখলাম ওদের ভেতর। করুণ ভঙ্গিতে একটু হেসে ও মাথা নাড়লো, ভাবখানা আমাদের সঙ্গে যেতে চায় কিন্তু জানে, পারবে না।