.
দুপুরের একটু পরে খানিয়া আতেনের সাথে বেড়াতে বের হলাম। পেছন পেছন আসছে খানিয়ার দেহরক্ষী বাহিনীর একদল সৈনিক। প্রথমেই সে আমাদের নিয়ে গেল মরণ-শ্বাপদদের যেখানে রাখা হয় সেখানে। লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত একটা উঠানে দুধরনের কুকুর দেখলাম। লাল আর কালো। কাল রাতেরগুলোর মতোই বিরাট একেকটা। আমাদের দেখামাত্র চঞ্চল হয়ে উঠলো তারা। রক্ত হিম করা স্বরে চেঁচাচ্ছে আর লাফাচ্ছে, পারলে এক্ষুণি বেরিয়ে এসে টুটি টিপে ধরে আমাদের। ভাগ্য ভালো, বেড়া যথেষ্ট মজবুত, তেমন কিছু করতে পারলো না ওরা।
এরপর খানিয়া নগর দেখাতে নিয়ে গেল। কাল রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে যেটুকু দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখার ছিলো না। সুতরাং একটু পরে যখন আতেন নদীর ওপর উঁচু একটা সেতু পেরিয়ে আমাদের ফসলের মাঠে নিয়ে গেল তখন মোটেই দুঃখ পেলাম না। কৃষকদের দেখলাম, মাঠে কাজ করছে। খানিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দাদের বংশধর। কৃষিকাজই এদের একমাত্র জীবিকা। জমির তুলনায় মানুষ বেশি বলে চাষবাস ছাড়া অন্য কাজে এক ইঞ্চি মাটিও এরা নষ্ট করে না। অদ্ভুত এক সেচের পদ্ধতি গড়ে তুলেছে দেশজুড়ে। সরু সরু খাল কেটে পানি নিয়ে আসা হয়েছে নদী থেকে মাঠের গভীর পর্যন্ত। অনেক স্ত্রীলোককেও দেখলাম খেতে কাজ করতে।
কোনো বছর যদি খরা বা অতিবৃষ্টি হয় তাহলে কি ঘটে আপনাদের এখানে? জিজ্ঞেস করলো লিও।
দুর্ভিক্ষ, গম্ভীর মুখে জবাব দিলো খানিয়া। হাজার হাজার মানুষ তখন না খেয়ে মরে।
এ বছরটা কেমন? ভালো না মন্দ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
খুব সম্ভব মন্দ। এখনও নদীর পানি যথেষ্ট বাড়েনি। বৃষ্টিও হয়নি খুব বেশি। এ-অবস্থা চললে কদিন পরে সেচের পানি পাওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যায় আবার অগ্নি-পর্বতের চূড়ায় আগুন দেখা গেছে। ওটা অশুভ সংকেত। যে বছর ঐ চূড়ায় আগুন দেখা দেয় সে বছর খরা হয়।
সেক্ষেত্রে এখনই ঐ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত আমাদের, একটু হেসে লিও বললো।
মানে? তোমরা মৃত্যুর মাঝে আশ্রয় চাও? মুখ কালো করে বললো খানিয়া। বিদেশী অতিথি, শুনে রাখো, আমি বেঁচে থাকতে ওখানে যেতে পারবে না তুমি।
কেন নয়, খানিয়া?
আমার ইচ্ছা, প্রভু লিও। এদেশে আমার ইচ্ছাই আইন। চলো ফেরা যাক।
.
১০.
এরপর দীর্ঘ তিনটে মাস আমাদের কাটাতে হলো কালুন নগরীতে। ভয়ঙ্কর, জঘন্য, ঘৃণিত তিনটে মাস। জীবনে আর কখনও এত বাজে সময় কাটেনি আমাদের। একদিকে খানের হুমকি, অন্যদিকে খানিয়ার। খানিয়া শুধু হুমকি নয়, মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ভালো ব্যবহার করে, সেটা আরও অসহ্য লাগে আমার কাছে। লিওর কাছেও। দেশের জনসাধারণ মোটেই ভাল দৃষ্টিতে দেখছে না। আমাদের। খানিয়ার কথাই সত্যি হয়েছে ভয়ঙ্কর খরা এবং অনাবৃষ্টি শুরু হয়েছে কালুনে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার জনগণ সেজন্যে দুই বিদেশী আগন্তুককেই দায়ী করছে। আমরা বাইরে বেরোলে ওরা দল বেঁধে দেখতে আসে। দু’একজন বলাবলিও করে, ওদের এই দুরবস্থার জন্যে আমরাই দায়ী। শেষে এমন . হলো, বাইরে বেরোনোই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। মাঝে মাঝে দু’একবার যা বেরোই তা খানিয়ার সঙ্গে। ব্যাপারটা আরও ব্রিতকর। খানিয়ার উদ্দেশ্য আমরা জানি তাই চেষ্টা করি ওকে এড়িয়ে চলার। তবু ওর ইচ্ছায় ওর সাথে যখন বেরোতে হয়, আমাদের, বিশেষ করে লিওর মনের অবস্থা কেমন হয়, সহজেই অনুমেয়।
এক রাতে সিমব্রি তার প্রাসাদচূড়ার ঘরে আমাদের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখলাম, গম্ভীর হয়ে গেছে লিও। কি যেন ভাবছে।
বন্ধু সিমব্রি, হঠাৎ বলে উঠলো সে, আপনার কাছে একটা অনুগ্রহ চাইবো–খানিয়াকে একটু বলবেন, দয়া করে যেন আমাদের পথে চলে যেতে দেয়। আমাদের।
বুড়ো শামানের চতুর মুখটা মুহূর্তে যেন পাথরে গড়া হয়ে গেল।
তুমি নিজেই তো একথা বলতে পারো খানিয়াকে। আমার মনে হয় না ও অস্বীকার করবে।
বলেও যে লাভ হয়নি তা বোধহয় আমার চেয়ে আপনি ভালো জানেন। ফালতু কথা বাদ দিয়ে আসুন বাস্তব অবস্থাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক-আমার মনে হয়েছে খানিয়া আতেন তার স্বামীকে নিয়ে সুখী নয়।
তোমার দৃষ্টি খুব প্রখর।
আমার আরও মনে হয়েছে, বলতে বলতে একটু লাল হলো লিওর মুখ, আমার প্রতি, সত্যি কথা বলতে কি, অযাচিত ভাবেই একটু বেশি সৌজন্য দেখাচ্ছে খানিয়া।
তোরণ-গৃহের সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলছো তো?
না, শুধু তোরণ-গৃহে না, এখানে আসার পরও কিছু স্মৃতির জন্ম হয়েছে।
দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে শামান বললো, তারপর?
তারপর আর বিশেষ কিছু না। সিমব্রি, আমি চাই না আপনার দেশের প্রথম রমণীর নামে কলঙ্ক রটুক।
কিছু এসে যায় না, কিছু এসে যায় না। তুমি যাকে কলঙ্ক বলছে তা নিয়ে এদেশের মানুষ খুব একটা মাথা ঘামায় না। যাহোক, কলঙ্ক ছাড়াই যদি সব ব্যাপার গুছিয়ে নেয়া যায়? যদি, ধরো, খানিয়া নতুন একটা স্বামী পছন্দ করে?
তা কি করে সম্ভব? এক স্বামী জীবিও আঁকতে আর এক স্বামী কি করে গ্রহণ করবে ও!
এখনকার স্বামী যদি আর বেঁচে থাকে? মরতে কতক্ষণ? খান র্যাসেন যে হারে মদ গিলছে আজকাল!
মানে লোকটাকে খুন করা হবে! ভয়ানক হয়ে উঠেছে লিওর চেহারা। না, শামান সিমব্রি, এ ধরনের কাজ আমার দ্বারা হবে না।