পাগল হোক আর যা-ই হোক, গরগরিয়ে উঠলো লিও, আমার ওপর ওই অভিশপ্ত কুত্তাগুলোকে লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আমি ওর ঘাড় ভেঙে ফেলবো।
আমি আর কিছু বলার আগেই খানিয়া ইশারায় তার পাশে বসতে বললো ওকে। অন্যপাশে বসালো আমাকে, ও আর ওর চাচা অভিভাবকের মাঝখানে। আর খান বসলো কয়েকটা চেয়ার পরে সুন্দরী দুই রমণীর মাঝখানে।
খাবার পরিবেশন করা হলো। মাছ, ভেড়ার মাংস, মিষ্টি। সবই অত্যন্ত সুস্বাদু। তারপর দেয়া হলো কড়া পানীয়। পথে কষ্ট হয়েছে কিনা—এই ধরনের দু’একটা প্রশ্ন করলো খানিয়া আমাকে। বাকি সময়টুকু লিওর সাথে গল্প করে গেল সে। আর আমি আলাপ জমালাম বৃদ্ধ শামান সিমব্রির সাথে। তার কাছ থেকে যা যা জানতে পারলাম তা হলো—
বাণিজ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অপরিচিত কালুনের মানুষদের কাছে। এর প্রধান কারণ বাইরের দুনিয়ার সাথে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। দেশটা বড় এবং ঘনবসতিপূর্ণ হলেও চারদিক দিয়ে দুর্গম পাহাড় ঘেরা বলে বাইরে থেকে কেউ আসতে পারে না, এখান থেকেও কেউ যায় না বাইরে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। নিজেরা যা উৎপাদন করে তা নিয়েই খুশি সবাই। প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস নিজেরাই তৈরি করে নেয়। ধাতুশিল্পেও মোটামুটি উন্নত কালুন। টাকা পয়সার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিনিময়ই ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। রাজস্বের মাধ্যমও তাই।
প্রাচীনকালে যে বিদেশী জাতি স্থানীয়দের পদানত করেছিলো সংখ্যায় খুব কম হলেও এখনও তারাই শাসন করছে দেশটা। শাসক শাসিত বা বিজয়ী বিজিত কোনো পক্ষই রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী নয়-কোনো কালেই ছিলো না। ফলে একটা প্রায় অসভ্য আর একটা সুসভ্য জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই জাতি। তবে শাসন ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে বিদেশ থেকে আসা লোকদের হাতেই।
সংখ্যায় যখন ওরা এত অল্প, সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয়রা ওদের শাসন মেনে নিচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কাঁধ ঝাঁকালো সিমব্রি। স্থানীয়রা মোটেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, তাই ব্যাপারটা। সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান খানিয়াকে দুপক্ষই পছন্দ করে। বিশেষ করে দরিদ্ররা। আর দরিদ্রের সংখ্যাই এদেশে বেশি। অবশ্য খানিয়াকে সবাই যেমন পছন্দ করে খানকে তেমন করে অপছন্দ। জনসাধারণ তো মাঝে-মধ্যে। খোলাখুলিই বলে, অত্যাচারী খান মরলে তারা খুশি হয়, সেক্ষেত্রে খানিয়া নতুন একজন স্বামী বেছে নিতে পারবে। পাগল হলেও খান এসব কথা জানে। সেজন্যে দেশের প্রতিটা গণ্যমান্য লোককে ও সন্দেহ করে, ঈর্ষা করে।
ঈর্ষা কেন বলছেন, আমি বললাম, সত্যি সত্যি ও হয়তো স্ত্রীকে ভালোবাসে।
হয়তো। কিন্তু আতেন তো ওকে ভালোবাসে না। ওর সভাসদ, মানে এখানে যারা আছে তাদেরও কাউকে না।
সত্যিই তাই, এসব লোককে পছন্দ করা প্রায় অসম্ভব। ঘণ্টাখানেকও হয়নি খেতে এসেছে, এর ভেতরে সবাই পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছে। মেয়েরাও বাদ যায়নি। খানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। চেয়ারে হেলান দিয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করছে। এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে সুন্দরী এক সঙ্গিনীর গলা। অন্য এক সুন্দরী সোনার পেয়ালায় করে মদ ঢেলে দিচ্ছে তার গলায়।
দেখ, লিওকে বললো খানিয়া, বিরক্তিতে কুঁচকে উঠেছে চোখ-মুখ, দেখ আমার সঙ্গীদের অবস্থা দেখ। কালুনের খানিয়া মানে কি তা বোঝো!।
রাজসভা থেকে এদের বিদায় করে দেন না কেন? জিজ্ঞেস করলো লিও।
বিদায় করলে রাজসভা বলেই কিছু থাকবে না যে। এদের চেয়ে ভালো স্বভাবের মানুষ এদেশে কই? নিরীহ গরীব মানুষের কঠোর শ্রমে উপার্জিত সম্পদে ফুর্তি করে এরা। ছি! হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল খানিয়ার। যাকগে, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? যাও বিশ্রাম করোগে। কাল আমরা একসাথে ঘোড়ায় চড়তে বেরোবো। একজন রাজপুরুষকে ডেকে আমাদের পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিলো সে।
মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা। সিমব্রি-ও যাচ্ছে আমাদের পৌঁছে দেয়ার জন্যে। বিশাল হলঘরটার দরজার কাছে পৌঁছে গেছি, এমন সময় পেছন থেকে শোনা গেল খানের কণ্ঠস্বর–
আমাদের খুব ফুর্তিবাজ মনে হলো, না? কেন হবে না? কদিন বাঁচবো কেউ বলতে পারে? কিন্তু তুমি, এই হলদে-চুলো ব্যাটা, আতেনকে অমন করে তাকাতে দিয়ো না তোমার দিকে। ও আমার বউ। আর কখনও যদি দেখি ও অমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে, তাহলে, বলে দিচ্ছি, নির্ঘাৎ তোমাকে শিকার করবো আমি।
হো-হো করে উঠলো অন্য মাতালগুলো। ঘুরে দাঁড়াতে গেল লিও। কিন্তু তার আগেই সিমব্রি ওর হাত ধরে বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে।
বাইরে বেরিয়েই লিও সিমব্রিকে বললো, বন্ধু, তোমাদের খান আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই, জবাব দিলো অভিভাবক। খানিয়া যতক্ষণ হুমকি দিচ্ছে না ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। আসলে তো দেশের শাসনকর্তা আতেন, আমি ওকে সহায়তা করি।
তাহলে আপনাকেই বলছি, বললো লিও, ঐ মাতাল লোকটার কাছ থেকে দূরে রাখবেন আমাকে। আমি যদি আক্রান্ত হই তাহলে কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো।
সেক্ষেত্রে কে তোমাকে দোষ দেবে? সূক্ষ্ম, রহস্যময় একটা হাসি হেসে বললো সিমব্রি।
ইতিমধ্যে আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের থাকার জায়গায়। বিদায় নিলো বৃদ্ধ শামান। দুটো বিছানাই এক ঘরে এনে শুয়ে পড়লাম আমি আর লিও। এক ঘুমেই রাত শেষ। ভোরে মরণ-শ্বাপদের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমাদের।