তোরণ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। একটু পরে দ্বিতীয় একটা ফটকের সামনে পৌঁছুলাম। ভেতর থেকে বন্ধ। সিমব্রি এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলো দরজায়। ওপাশ থেকে দুর্বোধ্য ভাষায় সাড়া দিলো কেউ। একই ভাষায় কিছু একটা জবাব দিলো সিমব্রি। প্রায় সাথে সাথে খুলে গেল ফটকের ভারি কপাট। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। দুপাশে বাগান, মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে পথ।
বাগান পেরিয়ে বিরাট একটা দালান বা প্রাসাদের সামনে পৌঁছলাম। দালানটার এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে মাথা তুলে আছে নিরেট পাথরের উঁচু উঁচু চূড়া। দেখলেই বোঝা যায় প্রাচীন মিশরীয় রীতিতে তৈরির চেষ্টা হয়েছিলো, কিন্তু কারিগরদের সাধ্যে কুলায়নি।
প্রাসাদের দরজা পেরিয়ে একটা বারান্দা ঘেরা উঠান। এই উঠান থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন কামরায়। এগুলোরই একটা ধরে অবশেষে পৌঁছুলাম আমাদের জন্যে নির্ধারিত বাসস্থানে। একটা বসার আর দুটো শোবার ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে ওটা। তিনটে ঘরই জমকালো আসবাবপত্রে ঠাসা, সবই প্রাচীন ঢংয়ের। তেলের লণ্ঠন জ্বলছে ঘরগুলোয়।
আমাদের রেখে বিদায় নিল সিমব্রি। যাওয়ার আগে বলে গেল, রক্ষীদলের প্রধান বাইরের ঘরে অপেক্ষা করবে। আমরা তৈরি হয়ে বেরোলেই সে আমাদের খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাবে।
শোয়ার ঘরে ঢুকে দেখি কয়েকজন ভৃত্য, সম্ভবত ক্রীতদাস, অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। আচার ব্যবহারে কেতাদুরস্ত। এদের সহায়তায় ভ্রমণের পোশাক ছেড়ে সাদা স্কারের নতুন ফ্রক কোট গায়ে চাপালাম। অন্য পোশাকগুলোও বদলে নিতে হলো। অবশেষে ভৃত্যরা মাথা নুইয়ে জানালো, আমাদের বেশ বিন্যাস সমাপ্ত।
বাইরের ঘরে এলাম। রক্ষীপ্রধান বিনীত ভঙ্গিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। অনেকগুলো ছোট বড় ঘর পেরিয়ে, বাক নিয়ে অবশেষে পৌঁছুলাম খাওয়ার ঘরে। বিশাল একটা হলকামরা। অনেকগুলো লণ্ঠনের আলোয় উজ্জ্বল আলোকিত। দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ করা পর্দা। ঘর গরম রাখার জন্যে এক ধারে বড় একটা চুল্লীতে পিট কয়লা পুড়ছে।
কামরার এক প্রান্তে একটা বেদীমতো। তার ওপরে সরু, লম্বা একটা কাপড়ঢাকা টেবিল। টেবিলে রুপোর ঝকঝকে বাসন পেয়ালা সাজানো। কোনো মানুষ নেই এ-ঘরে। রক্ষী-প্রধানের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একটু পরে এক ধারের পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো খানসামারা। তাদের পেছনে রূপার ঘণ্টায় বাড়ি দিতে দিতে একজন লোক; তারপর দশ বারোজন সভাসদের একটা দল, প্রত্যেকে আমাদের মতো সাদা পোশাক পরা। তাদের পেছন পেছন এলো সমসংখ্যক রমণী। বেশিরভাগই যুবী, সুন্দরী। আমাদের সামনে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো তারা। আমরা জবাব দিলাম, একই ভঙ্গিতে।
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ওরাও। পরস্পরকে পরীক্ষা করছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। অবশেষে তীক্ষ্ণ্ণস্বরে শিঙা বেজে উঠলো কোথাও। নকীব এসে ঘোষণা করলো–কালুনের মহামান্য খান ও খানিয়া আসছে! পর্দার ওপাশে একটা আলোকিত সরু পথে দুটো মূর্তি দেখা গেল—খান এবং খানিয়া। তাদের পেছনে শামান সিমব্রি ও কয়েকজন রাজপুরুষ।
হলঘরে প্রবেশ করলো খান। কেউ মুখ তুলে তাকালো না। সবার চেহারায় কেমন একটা অস্বস্তির ভাব চেপে বসেছে। খানের পরনেও সাদা পোশাক। পার্থক্য একটাই, আমরা বা পারিষদরা যেগুলো পরে আছি তার চেয়ে ওগুলো অনেক মূল্যবান, কাটছাটেও অন্যরকম। প্রথমেই আমার চোখ পড়লো ওর সেই উন্মত্ত চোখ দুটোর ওপর। এখনও তেমনি ভয়ঙ্কর পৈশাচিক দৃষ্টি তাতে। এমনিতে লোকটা দেখতে খারাপ না। চমৎকার স্বাস্থ্য। কেবল ঐ চোখ দুটো-ভয়ঙ্কর ক্রোধে জ্বলছে যেন সবসময়। আর খানিয়া-তোরণ-গৃহে যেমন দেখেছিলাম এখনও তেমন। সুন্দর। কেবল একটু দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে চেহারায়। আমাদের দেখা মাত্র একটু লাল আভা ধারণ করলো তার গাল। তবে মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আমাদের এগোনোর ইশারা করে স্বামীকে বললো-প্রভু, এরা সেই আগন্তুক, এদের কথাই বলেছিলাম তোমাকে।
আমার ওপরেই প্রথমে পড়লো খানের চোখ। একটু যেন মজা পেলো আমার চেহারা দেখে। অভদ্রের মতো হেসে উঠলো জোরে। তারপর স্থানীয় ভাষার মিশেল দেয়া জঘন্য গ্রীকে বললো
কি অদ্ভুত একটা বুড়ো জন্তু! আগে কখনও দেখিনি তোমাকে, তাই না?
না, মহানুভব খান, আমি জবাব দিলাম, তবে আমি আপনাকে দেখেছি। আজ সন্ধ্যায়ই। আপনি শিকারে বেরিয়েছিলেন। পেলেন কিছু?
সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হলো সে। হাত ঘষতে ঘষতে জবাব দিলোপেয়েছি মানে? দারুণ জিনিস। দৌড়ে পালালেঞ্জিচেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমার কুকুরগুলো শেষ পর্যন্ত ওকে ধরে ফেলতে পেয়েছিলো। তারপর–
তোমার এসব নিষ্ঠুর কথাবার্তা থামাও তো! চিৎকার করলো খানিয়া।
আতেনের কাছ থেকে একটু সরে এলো খান। লিওর দিকে তাকালো।
সোনালি দাড়িওয়ালা বিশালদেহী লিওকে এই প্রথম ভালো করে লক্ষ করলো সে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
তুমি নিশ্চয়ই খানিয়ার অপর বন্ধু? অবশেষে কথা ফুটলো তার মুখে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কেন অত কষ্ট স্বীকার করে ও পার্বত্য-তোরণের কাছে গিয়েছিলো! ভালো কথা, তুমি কিন্তু সতর্ক থেকো, না হলে তোমাকেও শিকার হতে হবে।
শুনেই রেগে গেল লিও। জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে যাবে, বাধা দিলাম আমি। ইংরেজিতে বললাম, উহুঁ, কিছু বোলো না, লোকটা পাগল।