কি বলছে ওরা? জিজ্ঞেস করলো লিও।
প্রার্থনা করছে, ওই আলো—যার নাম হেস-এর পথ—ওদের কোনো ক্ষতি যেন না করে। ওদের বিশ্বাস এই আলো দেখা দেয়ার অর্থ অমঙ্গল নেমে আসবে দেশের ওপর।
মানে, সব সময় এই আলো দেখা যায় না?
না, খুব কম। তিন মাস আগে একবার দেখা গিয়েছিলো, আর এখন। এর আগে বেশ কয়েক বছর আর দেখা যায়নি।
একটু পরে চাঁদ উঠলো, উজ্জ্বল সাদা একটা গোলক। জ্যোৎস্নায় দেখলাম, ক্রমেই নগরের কাছাকাছি হচ্ছি আমরা। নিঃশব্দে বসে আছি। আকাশের চাঁদ আর নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব দেখছি। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছি দূরে আলোকিত শহরটার দিকে। জল কেটে নৌকা এগোনোর মৃদু ছলাৎ ছল ছাড়া। আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো, একটা চিৎকার। অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না, কেউ প্রাণের ভয়েই অমন চিৎকার করছে।
ক্রমে এগিয়ে আসছে চিৎকারের শব্দ। প্রতি মুহূর্তে স্পষ্ট এবং তীব্র হয়ে উঠছে। হঠাৎ দেখলাম মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে আসছে অস্পষ্ট কয়েকটা মূর্তি। নদীর যে পাশ দিয়ে আমাদের টাটুগুলো দৌড়ে চলেছে তার উল্টো পাশে। একটু পরেই চমৎকার তেজী একটা সাদা ঘোড়া উঠে এলো ওপাশের বাঁধানো পথের। ওপর। তার পিঠে একজন মানুষ। চিৎকারটা সে-ই করছে। সোজা হয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো লোকটা। চাঁদের আলোয় চকিতের জন্যে তার মুখ দেখতে পেলাম। স্পষ্ট আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় যেন আঁকা রয়েছে সে মুখে।
ঝড়ের বেগে আমাদের পেরিয়ে গেল সে। তারপর, যেমন আচমকা ঘোড়াটা বেরিয়ে এসেছিলো তেমনি অকস্মাৎ বিশাল এক লাল কুকুর উঠে এলো পাড়ের নিচের অন্ধকার থেকে। ভয়ঙ্কর বেগে ছুটছে সেটা ঘোড়সওয়ারের পেছন পেছন। এক সেকেণ্ড পর আরেকটা কুকুর উঠে এলো বাঁধানো পথের ওপর। তারপর আরও একটা, তারপর অনেকগুলো।
মরণ-শ্বাপদ! লিওর হাত আঁকড়ে ধরে বিড় বিড় করে বললাম আমি।
হ্যাঁ! বললো ও। হতভাগা লোকটাকে তাড়া করছে। এই যে, শিকারী এসে গেছে।
বলতে না বলতেই দ্বিতীয় অশ্বারোহী উঠে এলো রাস্তায়। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া আলখাল্লাটা বাতাসে উড়ছে। বাদুড়ের ডানার মতো। লম্বা একটা চাবুক লোকটার হাতে। আমাদের পাশ দিয়ে। যখন ছুটে যাচ্ছে এ-ও তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। আমরা দেখলাম উন্মাদের দৃষ্টি তার চোখে। কোনো সন্দেহ নেই এ লোক পাগল!
খান! খান! বলে উঠলো সিমব্রি, সেই সাথে মাথা নোয়ালো কুর্নিশের ভঙ্গিতে।
কয়েক সেকেণ্ড পর দেখতে পেলাম খানের রক্ষীদের। সংখ্যায় আটজন। এদের হাতেও চাবুক। একটু পরপরই তাদের ঘোড়াগুলোর পিঠে সপাং করে বাড়ি পড়ছে।
শব্দগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ সবের অর্থ কি, বন্ধু সিমব্রি?
খান তার নিজের রীতিতে বিচার করছেন, জবাব দিলো সে। যে তাঁর ক্রোধ জাগিয়েছে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে ইঁদুরের মতো তাড়া করে অবশেষে হত্যা করবেন।
ও কে? অপরাধই বা কি?
লোকটা জমিদার। এদেশে এত বড় জমিদার খুব কমই আছে। ওর অপরাধ, ও খানিয়ার কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলো। খানিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলো, ওকে যদি বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে ও খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে হত্যা করবে। আতেন রাজি হয়নি ওর প্রস্তাবে, বরং খানকে জানিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা। এই হলো ঘটনা।
এমন একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী যার তাকে ভাগ্যবান না বলে উপায় নেই! কথাটা আমি না বলে পারলাম না। বৃদ্ধ ঝট করে ফিরলো আমার দিকে, তারপর যেন কিছু শোনেনি এমন ভঙ্গিতে হাত বুলাতে লাগলো তার শ্বেতশুভ্র দাড়িতে।
একটু পরেই আবার শোনা গেল মরণ-শ্বাপদের চিৎকার। হ্যাঁ, আবার এগিয়ে আসছে তারা। এবারও মাঠের ভেতর দিয়ে প্রথমে সাদা ঘোড়াটা, তারপর শ্বাপদগুলো। দূরত্ব অনেক কমে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিশ্রান্ত সাদা ঘোড়াটা। আগের মতো দ্রুত ছুটতে পারছে না। কোনোমতে বাঁধানো পাড়ের ওপর উঠলো সেটা। পরমুহূর্তে দেখলাম বিশাল লাল কুকুরগুলোর একটা লাফ দিলো। হাঁ হয়ে আছে মুখ। চাঁদের আলোয় তার শ্বদন্তগুলো ঝিকিয়ে উঠলো। নিমেষে মাঝের দূরত্বটুকু অতিক্রম করে কামড় বসালো সাদা ঘোড়ার পেছনের পায়ে। তীব্র আতঙ্কে তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার করে দুপায়ের ওপর খাড়া হয়ে গেল। ঘোড়াটা। ছিটকে পড়ে গেল আরোহী। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেছে পেছনের শ্বাপদগুলো। মুহূর্তে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো হতভাগ্য জমিদারকে। লাগাম টেনে ঘোড়া দাঁড় করালো খান। তাকিয়ে আছে উন্মত্ত জানোয়ারগুলোর দিকে। ধীরে ধীরে পরিতৃপ্তির পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে।
.
০৯.
একটু পরে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে দ্বীপের যেখানটায় নদী দুভাগ হয়েছে সেই বিন্দুতে। পাথরের একটা জেটিতে নৌকা ভিড়লো। আমরা নেমে এলাম। একদল রক্ষী আমাদের স্বাগত জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। তাদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম নগর-তোরণের দিকে।
আর দশটা প্রাচীন মধ্য এশীয় নগরের মতো দেখতে কালুন শহর। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। স্থাপত্যশৈলীতে সৌন্দর্যের ছাপ বিশেষ নেই। খুব একটা বড়ও নয় নগরটা। সরু সরু পাথর বাঁধানো রাস্তা, আর সমতল ছাদওয়ালা বাড়িঘর-ব্যস।