বেশ, আমি বললাম, এবার চুপ করে বোসো। চমকে উঠো না বা জোরে কথা বলে ফেলো না, হালের লোকটা গুপ্তচর হতে পারে, হয়তো তোমার আমার আচরণ সব পরে জানাবে সিমব্রিকে।
এরপর গিরিখাতের মাঝামাঝি বাঁক থেকে ওর পড়ে যাওয়ার পর এ-পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললাম। হাঁ করে শুনলো লিও।
কী বিস্ময়কর কাহিনি! অবশেষে স্বর বেরোলো ওর গলা দিয়ে। কে এই। হেসা, আর খানিয়াই বা কে?
তোমার কি মনে হয়? কে হতে পারে?
আমেনার্তাস? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো ও। আমার-মানে ক্যালিক্রেটিসের স্ত্রী? মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে?
মাথা ঝাকালাম আমি। আমার তা-ই মনে হয়। বুড়ো বুদ্ধ সন্ন্যাসী কেউ এন যদি হাজার বছর আগের স্মৃতি মনে করতে পারে, যাদুকর চাচা সিমব্রির সাহায্য নিয়ে খানিয়া কেন পারবে না? প্রথম দর্শনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের প্রেমে পড়ে যাওয়ার এ ছাড়া আর কোনো কারণ তো দেখি না।
তোমার কথায় যুক্তি আছে, হোরেস। আর তা যদি হয়, খানিয়ার জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বেচারা ইচ্ছে থাক না থাক জড়িয়ে গেছে এতে।
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যে আবার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছো সে খেয়াল আছে? নিজেকে সামলাও, লিও, নিজেকে সামলাও। আমার বিশ্বাস, এটা একটা পরীক্ষা তোমার জন্যে। হয়তো সামনে এমন আরও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে।
জানি, বললো লিও, ভালো করেই জানি। তোমার ভয় না পেলেও চলবে। এই খানিয়া অতীতে আমার কি ছিলো না ছিলো তাতে কিছু আসে যায় না। এখন আমি আয়শাকে খুঁজছি, এবং একমাত্র আয়শাকে, স্বয়ং ভেনাসও যদি চেষ্টা করে, আমাকে প্রলোভিত করতে পারবে না।
.
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আমাদের নৌকা পাড়ের সাথে মৃদু একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। পেছনের নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওটাও তীরে ভিড়েছে। সিমব্রি নেমে আসছে। একটু পরেই আমাদের নৌকায় উঠে এলো সে। গম্ভীর মুখে আমাদের সামনে একটা আসনে বসলো।
তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে আমার ওপর, বললো বৃদ্ধ। রাত হয়ে আসছে, আর দূরে থাকা সমীচীন মনে করলাম না। তাছাড়া এখন একটু সঙ্গও দিতে পারবো তোমাদের।
আর পাহারাও দিতে পারবে, আমরা পালানোর চেষ্টা করি যদি, বিড়বিড় করে ইংরেজিতে বললো লিও।
আবার চলতে শুরু করলো ঘোড়াগুলো। সেই সাথে নৌকাগুলোও।
ঐ যে আমাদের রাজধানী, একটু পরে সিমব্রি বললো। ওখানেই আজ রাতে ঘুমাবে তোমরা।
সিমব্রির ইশারা অনুসরণ করে তাকালাম আমরা। মাইল দশেক দূরে শহরটা। বিশাল বলবো না, তবে বেশ বড়। সমভূমি থেকে প্রায় নয়শো ফুট উঁচু একটা মাটির স্কুপের ওপর গড়ে উঠেছে। শহরটাকে মাঝখানে রেখে দুভাগে ভাগ হয়ে এগিয়ে গেছে নদী।
কি নাম শহরটার? জিজ্ঞেস করলো লিও।
কালুন, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার পূর্ব পুরুষরা যখন জয় করে এদেশ, দুহাজার বছর আগে, তখনও এই নাম ছিলো। প্রাচীন নামটা বদলানো হয়নি। তবে সেনাপতির ইচ্ছায় ঐ পাহাড় আর সংলগ্ন এলাকার নতুন নামকরণ করা হয়। কারণ ওটার চূড়ায় যে স্তম্ভ আর আংটা আছে তা ওদের সেনাপতির উপাস্য দেবীর প্রতীকের মতো দেখতে। সেই দেবীর নামানুসারে ঐ এলাকার নাম দেয়া হয় হেস।
এখনও নিশ্চয়ই পূজারিণীরা আছে ওখানে, বুড়োর পেট থেকে কিছু কথা বের করা যায় যদি, এই আশায় বললো লিও।
হ্যাঁ, পূজারীও আছে। বিজয়ীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো ঐ মঠ। স্থানীয় দেবতা পার্বত্য-অগ্নির মন্দির ছিলো ওখানে। সেই মন্দিরকেই হেস-এর মঠে রূপান্তরিত করা হয়।
এখন ওখানে কার পূজা হয়?
দেবী হেস-এর। সে রকমই ধারণা সবার। এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমরা। আমাদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শক্রতা পাহাড়ের ওদের। সুযোগ পেলেই আমরা বা ওরা একে অপরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করি। তবে চেষ্টাটা ওদের তরফ থেকেই বেশি হয়। আমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করি কেবল। এমনিতে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। আক্রান্ত না হলে কখনও আক্রমণ করি না। চারদিকে তাকিয়ে দেখ, শান্তির দেশ মনে হয় না?
সত্যিই তাই, নদীর দুপারে শুয়ে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ সম্ভাবনা। চারণভূমিতে চরছে গবাদি পশুর পাল, অথবা ঘোড়া খচ্চরের দল। গাছের সারি বা লাইল দিয়ে পৃথক করা চৌকোনা ফসলের খেত। গ্রামের মানুষরা মাঠের কাজ শেষে বাড়ির পথে চলেছে। ধূসর রঙের ঢোলা আলখাল্লা তাদের পরনে। অনেকে দিয়ে নিয়ে চলেছে নিজের নিজের পশুর পাল। দূরে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়, গাছপালায় ছাওয়া ঘরবাড়ি, গ্রাম। দেখে মনে হয় সত্যিই শান্তির দেশ কালুন।
মিসরীয় সেনাপতি আর তার অধীনস্থ গ্রীক সৈনিকরা কেন এ-দেশ জয়ের পর নিছক লুটতরাজ চালিয়ে ফিরে যায়নি তা অনুমান করতে অসুবিধা হলো না। বিশাল বিস্তৃত তুষার ছাওয়া মরুভূমি আর পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে এসে এমন সবুজ সুন্দর দেশ দেখে ওরা বোধহয় এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো, আর যুদ্ধ নয়, আমরা এখানেই থেকে যাবো, এখানেই মরবো। এবং স্থানীয় মহিলাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সত্যিই থেকে গিয়েছিলো এদেশে।…
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ দূরে অগ্নি-পাহাড়ের ওপরে ধোয়ার স্তর উজ্জ্বল কমলা রঙ ধারণ করলো। কমলা আভা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে এক সময় প্রায় সাদা হয়ে উঠলো। আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে লকলক করে বেরিয়ে এলো আগুনের শিখা। স্তম্ভের ওপরে আংটার ভেতর দিয়ে দূরে প্রক্ষিপ্ত হলো উজ্জ্বল আলো। কালুন নগরী, নদী, ফসলের মাঠ, বনভূমি পেরিয়ে সোজা ছুটে গেল– হ্যাঁ, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। পর পর তিনবার এমন হলো। তারপর ধীরে ধীরে আবার স্তিমিত হয়ে এলো অগ্নি-পাহাড়ের আগুন। মাঝিরা এবং অন্য সবাই ভীতরে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বিড় বিড় করে কি যেন আউড়ে চলেছে।