দৃশ্যটা আমাকে এমন ভাবে চমকে দিলো, আমি আর নড়তে পারলাম না। ভুলে গেলাম কেন এসেছি এই অদ্ভুত জায়গায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম
মুহূর্ত পরে বুঝতে পারলাম মিস্টার হলিও দেখতে পেয়েছেন কিছু একটা। অবয়বটার দিকে ফিরে দুর্বোধ্য স্বরে চিৎকার করলেন তিনি। একটা মাত্র উন্মত্ত আনন্দিত চিৎকার। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন তুষারের ওপর। সংবিৎ ফিরলো আমার। ছুটে গেলাম তাকে ওঠানোর জন্যে। ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। অস্পষ্ট অবয়বটা। দুহাত ছড়িয়ে পড়ে আছেন মিস্টার হলি। মৃত। দণ্ডটা তখনও ধরে আছেন শক্ত করে।
.
এরপর ডাক্তার যা লিখেছেন তা আর উদ্ধৃত করলাম না। মিস্টার হলির মৃতদেহ . কি করে বাসায় আনা হলো তার বিস্তৃত বর্ণনা আর সেই রহস্যময় অবয়ব সম্পর্কে। তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই তাতে।
যে বাক্সটার কথা উনি লিখেছেন সেটা নিরাপদে পৌঁছেছে আমার হাতে। নকশাগুলো সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই, তবে সিসট্রাম সম্পর্কে দুচার কথা বলতে চাই। স্ফটিকের তৈরি কুক্স আনসাতা বা হাতলওয়ালা কুশের মতো দেখতে। মিসরীয়দের কাছে জীবনের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় এই কুক্স আনসাতা। দণ্ড, কুশ এবং আংটা-এই তিনে মিলে এক জিনিস হয়ে উঠেছে ওটা। আংটার এপাশে ওপাশে ছারটে সরু সোনার তার। তিনটের সাথে আটকানো মূল্যবান রত্ন। ঝকমকে হীরা, সাগরনীল নীলকান্ত মণি আর রক্তলাল পদ্মরাগ। একদম ওপরের অর্থাৎ চতুর্থ তার থেকে ঝুলছে ছোট ছোট চারটে সোনার ঘণ্টা।
এই অদ্ভুত জিনিসটা যখন হাতে নিলাম তখন কেন জানি না একটু কেঁপে গেল আমার হাত। মিষ্টি মৃদু টুংটাং শব্দে বাজতে শুরু করলো ঘণ্টাগুলো। অপূর্ব এক সঙ্গীতে যেন পূর্ণ হয়ে উঠলো ঘর। তবু কেন যে শির শির করে উঠলো আমার শরীর বলতে পারবো না।
সব শেষে পাণ্ডুলিপির কথা—এ সম্পর্কেও আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পাঠক নিজেই বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন, এর বক্তব্য সত্য না মিথ্যা, নাকি গৃঢ় কোনো অর্থ লুকিয়ে আছে এর ভেতর।
-সম্পাদক।
০১.
যে রাতে লিও সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলো, তারপর বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ভয়ানক, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করা দীর্ঘ বিশটা বছর। আমার মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই। সে জন্যে আমি দুঃখিত নই মোটেই, বরং খুশি। যে রহস্যের কিনারা এই ভুবনে থেকে করতে পারলাম না অন্য ভুবনে গিয়ে হয়তো তার সমাধান খুঁজে পাবো।
আমি, লুডউইগ হোরেস হলি, ভীষণ অসুস্থ। প্রায় মৃত অবস্থায় ওরা আমাকে নামিয়ে এনেছে ঐ পাহাড় থেকে। জানালা দিয়ে দূরে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টা। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই শারীরিক, মানসিক দুভাবেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। কিন্তু আমি কি ভাবে জানি না এখনও টিকে আছি। ভারতের উত্তর সীমান্তের এক জায়গায় বসে এ-আখ্যান লিখছি। আরও এক বা দুমাস-যতদিন
মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠছি, এখানে থাকতে হবে আমাকে। তারপর ফিরে যাবো আমার জন্মভূমিতে মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে।
সেই অলৌকিক দৃশ্য দিয়েই শুরু করি।
১৮৮৫ সালে আমি আর লিও ভিনসি ফিরে এলাম আফ্রিকা থেকে। তখন নিঃসঙ্গতা ভীষণ ভাবে কাম্য হয়ে উঠেছিলো আমাদের কাছে। অমর আয়শার আকস্মিক মৃত্যুতে* যে ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়েছিলাম তার রেশ কাটিয়ে ওঠার জন্যে এর দরকারও ছিলো।
নিঃসঙ্গতার আশায় গিয়ে উঠেছিলাম কাম্বারল্যাণ্ড উপকূলে আমার পৈতৃক বাড়িতে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে আমাকে মৃত ভেবে কেউ যদি বাড়িটা দখল করে না নিয়ে থাকে তাহলে ওটা এখনও আমারই সম্পত্তি। মরার জন্যে ঐ বাড়িতেই আমি ফিরে যাবো কদিন পরে।
কাম্বারল্যাণ্ডের জনহীন উপকূলের সেই বাড়িতে এক বছর কাটিয়ে দিলাম যা হারিয়েছি তার জন্যে শোক করে।.কি করে আবার তাকে পাওয়া যায় তার পথও খুঁজেছি এই সময়ে, কিন্তু পাইনি। তবে যা পেলাম তার মূল্যও কম নয়, এখানে আমরা আমাদের হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। লিওর সাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলো আসল রং ফিরে পেয়েছে। প্রথমে ধূসর তারপর ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠেছে। আবার। হারানো সৌন্দর্যও ফিরে পেয়েছে ও।
তারপর এলো সেই রাত-আলোকোজ্জ্বল সেই মুহূর্ত।
আগস্টের এক বিষণ্ণ রাত। খাওয়া দাওয়ার পর সাগর তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমরা-আমি আর লিও। কান পেতে শুনছি সাগরের মৃদু গর্জন। মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি দূরে মেঘের বুকে বিদ্যুতের চমক। নিঃশব্দে হাঁটছি দুজন। হঠাৎ আমার হাত জড়িয়ে ধরলো লিও। ফোপাতে ফোঁপাতে আর্তনাদ করে উঠলো, আর পারছি না, হোরেস,-এখন আমাকে এভাবেই ডাকে ও-, এ যন্ত্রণা আমি আর সইতে পারছি না। আয়শাকে আর একটিবারের জন্যে আমি দেখতে চাই। না হলে পাগল হয়ে যাবো। আমার যা শরীর স্বাস্থ্য, আরও হয়তো পঞ্চাশ বছর বাঁচবোকিন্তু পাগল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
আর কি করার আছে তোমার?
শান্তি পাওয়ার সোজা রাস্তা ধরবো, শান্ত গলায় জবাব দিলো লিও। আমি মরবো। হ্যাঁ, আমি মরবো-আজ রাতেই।
ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আত্মহত্যা করতে চাইছে লিও! ক্রুদ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে।
কাপুরুষ নাকি তুমি, লিও? এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারছে না! অন্যেরা পারছে কি করে?
অন্যেরা মানে তো তুমি, হোরেস, শুকনো হেসে জবাব দিলো ও। তোমার ওপরেও অভিশাপ আছে…যাকগে, তুমি শক্ত তাই সহ্য করতে পারছো, আমি দুর্বল তাই পারছি না। জীবন সম্পর্কে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি সেটাও একটা কারণ হতে পারে। না, আমি পারবো না, হোরেস, কিছুতেই পিরবো না, মৃত্যু ছাড়া আর কোনো গতি নেই আমার।