হ্যাঁ, সেই চূড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা স্তম্ভ, তার ওপরে তেমনি প্রকাণ্ড একটা পাথুরে আংটা। এক দৃষ্টিতে আমরা তাকিয়ে আছি ওটার দিকে। যেন আমাদের সব আশা আকাক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে ওটার চেহারায়। খেয়াল করলাম, আমাদের সঙ্গীরা সবাই পাহাড়টা দেখা মাত্র মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো, সেই সাথে ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের তর্জনীর ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে একটা ভঙ্গি করলো। (পরে জেনেছিলাম, পাহাড়টার অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এ ভঙ্গি করে ওরা)। শামান সিমব্রিও বাদ গেল না।
আপনি কখনও গেছেন ওই পাহাড়ে? বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো লিও।
মাথা নাড়লো সিমব্রি। সমভূমির মানুষরা ওখানে যায় না। প্রথম কারণ হিংস্র জংলীরা। ওদের সাথে লড়াই না করে ওখানে যাওয়ার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, পাহাড়টার যখন প্রসববেদনা ওঠে গলিত পাথরের লাল স্রোত নেমে আসে ঢাল বেয়ে। গরম ছাই ছিটকে পড়ে চূড়া থেকে। কে যাবে ঐ ভয়ঙ্কর জায়গায়?
আপনাদের এলাকায় কখনও ছাই পড়ে না?
কখনও দেখিনি পড়তে, তবে শুনেছি পাহাড়ের আত্মা যখন ক্রুদ্ধ থাকে তখন পড়ে, সেজন্যেই আমরা ভয় করি ওটাকে।
কে এই আত্মা? উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল লিও।
আমি জানি না, অস্থিরভাবে বলল সিমব্রি। মানুষ কি আত্মা দেখতে পারে?
সবাই না পারুক আপনি যে পারেন তা আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।
সত্যিই তাই, বুড়োর দৃষ্টি এখন আর আগের মতো স্থির, নির্লিপ্ত নয়। কিছু একটা যেন ভেতরে ভেতরে খেচাচ্ছে তাকে।
তুমি আমাকে সম্মান করো তাই একথা বলছো, জবাব দিলো সিমব্রি। আসলে আমার ক্ষমতা অত দূরগামী নয়। যাকগে, আমরা ঘাটে পৌঁছে গেছি, বাকি পথ নৌকায় যেতে হবে।
বেশ বড়সড় আরামদায়ক নৌকাগুলো। পাল খাটানোর ব্যবস্থা আছে তবে মূলত গুণ টেনে চালানোর উপযোগী করেই তৈরি। লিও আর আমি উঠলাম বড়টায়। আনন্দের সাথে লক্ষ করলাম হালের লোকটা ছাড়া আর কেউ উঠলো না। এ নৌকায়। সিমব্রি আর বাকি লোকজন উঠলো পেছনেরটায়। পালকিটাও ভাঁজ করে উঠিয়ে দেয়া হলো পেছনের নৌকায়। লম্বা চামড়ার দড়ি বেঁধে টাট্টু দুটোকে জুড়ে দেয়া হলো দুই নৌকার সঙ্গে। এতক্ষণ পালকি বয়েছে, এবার নৌকা টেনে নিয়ে যাবে ওরা। নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দর বাঁধানো পথ, খালগুলোর ওপরে কাঠের সেতু। সুতরাং নৌকা টানতে অসুবিধে হবে না ওদের।
ওহ! অবশেষে আবার আমরা একসাথে হয়েছি, বললো লিও। মনে আছে, হোরেস, ঠিক এমনি নৌকায় করে আমরা পৌঁছেছিলাম কোর-এর সমভূমিতে? সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে।
হ্যাঁ, সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে। কিন্তু, লিও, বলো তো এখানে আসার পর যা ঘটেছে তার কতটুকু মনে আছে তোমার?
আঁ…, সেই মহিলা আর বুড়ো আমাদের নদী থেকে টেনে তুললো। তারপর…তারপর যা মনে আছে তা হলো ঘুম। জাগি, ঘুমাই, কিন্তু কতক্ষণ ঘুমের পর কতক্ষণ জেগেছি কিছুই মনে নেই। তারপর একবার, ঘুম ভাঙতেই দেখলাম অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। প্রথমে আমি ভাবলাম বুঝি– কার কথা বলছি বুঝতে পারছো তো? ঝুঁকে আমাকে চুমো খেলো সে। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো, ব্যাপারটা স্বপ্নও হতে পারে।
না স্বপ্ন নয়, আমি দেখেছি। তারপর?
তারপর আর কি? পরে আরও অনেকবার ওকে দেখেছি—ঐ খানিয়াকে, আলাপ করেছি গ্রীকে। কিন্তু, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের ব্যাপারে ও এমন উৎসাহী হয়ে উঠলো কেন বুঝতে পারছি না। কে ও, হোরেস?
কি আলাপ করেছে আগে বলো, তারপর আমি বলবো কে ও।
বেশ, বলছি শোনো-আগের আলাপগুলো এমন টুকরো টুকরো আর বিচ্ছিন্ন, প্রায় কিছুই মনে নেই—কাল রাতের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে, সেটাই বলি। রাতের খাওয়া শেষ করেছি সবেমাত্র। এটো বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেছে বুড়ো যাদুকর। শুয়ে পড়ার কথা ভাবছি। এমন সময় ঘরে ঢুকলো খানিয়া। একা। রানীর মতো সাজ পোশাক। সত্যি বলছি, রূপকথার রাজকন্যার মতো লাগছিল ওকে। মাথায় মুকুট, কালো চুলের ঢল নেমেছে ঘাড় ছাড়িয়ে।
তারপর, হোরেস, ও সরাসরি প্রেম নিবেদন করলো আমাকে। আমার চোখে চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমরা নাকি দূর অতীতে একে অপরকে চিনতাম। তারপর বললো, ও চায় আমাদের পুরনো পরিচয় নূতন করে ঝালিয়ে নিতে। নানাভাবে ওকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তা সম্ভব নয়। কিন্তু ও কি শোনে?
শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম আমি আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজছি। যা-ই হোক, আয়শা আমার স্ত্রী, তাই না, হোরেস? ও মৃদু হেসে কি বললো জানো? আমার সেই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে, ও-ই সে, এবং সেজন্যেই ও নদী থেকে বাঁচিয়েছিলো আমাকে। এমন ভাবে ও বলছিলো যে শেষ দিকে আমি প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম কথাগুলো। এমনও তো হতে পারে, আয়শার চেহারা বদলে গেছে।
হঠাৎ মনে পড়লো সেই চুলের গোছাটার কথা, বুকের কাছে চামড়ার থলেটা স্পর্শ করলো লিও। ওটা বের করে খানিয়ার চুলের সাথে মেলালাম। চুলগুলো দেখার সাথে সাথে কেমন হিংসুটের মতো হয়ে গেল ওর চেহারা। ভয় দেখাতে লাগলো আমাকে। ওগুলো ওর চুলের চেয়ে লম্বা তাই কি?
ওর এই চেহারা দেখে আমি বুঝে ফেললাম ও আয়শা হতে পারে না। চুপ করে শুয়ে রইলাম আমি। ও অনেক কথা বলে গেল। ভয় দেখালো। শেষে দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল ঘর থেকে। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়ার আওয়াজ শুনলাম। ব্যস, এটুকুই আমার গল্প।