না, আমি চাই ও আমার স্বামী হবে।
সেক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, ওকেও তোমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইতে হবে। ওর ভেতর তো তেমন কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। আর—আর, একজন স্ত্রীলোকের দুটো স্বামী থাকে কি করে?
বৃদ্ধের কাঁধে হাত রাখলো আতেন। তুমি ভালো করেই জানো, সিমব্রি, আমার কোনো স্বামী নেই। নামমাত্র যেটা আছে সেটা-ও থাকবে না, যদি তুমি আমার সহায় হও।
মানে! খুন করতে চাও ওকে? না, আতেন, এবার আর আমি তোমার সহায় হবো না। তোমার সহায় হতে গিয়ে বহু পাপের বোঝা চেপেছে আমার কাঁধে, আর না। যা করার তোমাকেই করতে হবে। যদি না পারো লোকটাকে চলে যেতে দাও পাহাড়ে।
অসম্ভব! কিছুতেই তা আমি হতে দেবো না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আতেন। অবশেষে বললো, তুমি না কি বিরাট শামান, যাদুকর, ভবিষ্যৎ বক্তা। গণা-পড়া করে বললো আমাদের ভবিষ্যৎ।
তুমি বলার আগেই অনেকখানি সময় আমি ব্যয় করেছি একাজে, ফলাফল শুভ নয়, আতেন। এটা ঠিক, তোমার আর ঐ লোকটার নিয়তি একসূত্রে গাঁথা, কিন্তু বিশাল এক দেয়াল মাথা তুলেছে দুজনের মাঝে। যতদিন এই পৃথিবীতে আছো সে দেয়াল সরবে না তোমাদের মাঝ থেকে। তবে আমি আর যেটুকু জানতে পেরেছি, মৃত্যুর মাঝ দিয়ে আবার তোমরা খুব কাছাকাছি আসবে একে অন্যের।
মৃত্যুই আসুক তাহলে, গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে বললো খানিয়া। সেখানে তো আর কেউ আমার ইচ্ছায় বাধা দিতে পারবে না।
অত নিশ্চিন্ত হয়ো না, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার ধারণা, মৃত্যু-সাগরের ওপারেও তোমাদের অনুসরণ করবে সেই অদৃশ্য শক্তি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, হেস-এর নিধুম চোখ ছুরির ফলার মতো চিরে চিরে দেখছে আমাদের গোপন আত্মাগুলোকে।
তাহলে মায়ার ধুলো দিয়ে অন্ধ করে দাও সে চোখ। কালই হেসার কাছে চিঠি দিয়ে দূত পাঠাও যে, দুজন বৃদ্ধ আগন্তুক এসেছে—খেয়াল কোরো, বৃদ্ধ–তারা এখন খুবই অসুস্থ, খাদের ওপর থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে গেছে, তিন মাসের আগে সুস্থ হবে না। বেটি হয়তো তোমার কথা বিশ্বাস করবে।…এবার আমি ঘুমোবো। সেই ওষুধটা দাও, সিমব্রি, যেটা খেলে স্বপ্নহীন ঘুমে রাত শেষ হয়ে যায়।
দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে আমি সরে এলাম সেখান থেকে। সিঁড়ির কোনায় অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালাম।
.
০৮.
পরদিন সকাল দশটা কি আরও পরে শামান সিমব্রি এলো আমার ঘরে। জিজ্ঞেস করলো, কেমন ঘুমিয়েছি রাতে।
মরার মতো, আমি জবাব দিলাম। ঘুমের ওষুধ খেয়েও মানুষ এমন নিচ্ছিদ্র ঘুম ঘুমাতে পারে না।
তবু, বন্ধু হলি, বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।
তাহলে বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছি। মাঝে মাঝে অমন হয় আমার। কিন্তু, বন্ধু সিমবি, আপনার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারেননি।
হ্যাঁ, সারারাত আমাকে তোরণ পাহারা দিতে হয়েছে।
কোন্ তোরণ? আমরা যেটা দিয়ে ঢুকেছি আপনাদের রাজ্যে?
না, অতীত আর ভবিষ্যতের তোরণ। যেখান দিয়ে…থাক, অত কথায় দরকার নেই; আমি যা বলতে এসেছি, এক ঘণ্টার ভেতর রাজধানীর পথে রওনা হতে হবে তোমাকে। তোমাদের স্বাগত জানানোর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছেন। খানিয়া আতেন।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু আমার পালিত পুত্রের কি অবস্থা?
ও-ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। সময় হলেই ওর দেখা পাবে। খানিয়ার ইচ্ছে তাই। এই যে, ক্রীতদাসরা তোমার কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়ে নাও।
বেরিয়ে গেল সিমব্রি। ভৃত্যদের সহায়তায় কাপড় পরতে শুরু করলাম। প্রথমে চমৎকার পরিষ্কার লিনেনের অন্তর্বাস, তারপর পশমের মোটা ট্রাউজার্স ও গেঞ্জি এবং সব শেষে ফারের কিনারা লাগানো কালো রং করা উটের পশমের আলখাল্লা, দেখতে অনেকটা লম্বা ঝুল কোটের মতো। কাঁচা চামড়ার একটা টুপি আর এক জোড়া বুটের মাধ্যমে শেষ হলো আমার বেশ বিন্যাস।
পোশাক পরা শেষ হতে না হতেই হাজির হলো হলদেমুখো ভৃত্যরা। আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেডে, বারান্দা পেরিয়ে নিয়ে চললো তোরণ গৃহের দরজার দিকে। সেখানে পৌঁছে সবি আঁয়ে দেখলাম সিমব্রির সাথে দাঁড়িয়ে আছে লিও। মুখটা একটু ফ্যাকাসে। না হলে বলতে পারতাম সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ওকে। আমার মতোই পোশাক পরেছে। পার্থক্য একটাই, ওর স্কুল কোটটা সাদা। আমাকে দেখে এক লাফে এগিয়ে এলো ও। আনন্দে চকচক করে উঠেছে দুচোখ। কেমন আছি, এই কদিন কোথায় ছিলাম এসব নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চললো।
সিমব্রির সামনে যেগুলোর জবাব দিলে অসুবিধা নেই সেই প্রশ্নগুলোরই জবাব দিলাম শুধু। বাকিগুলো পরে কোনো এক ফাঁকে দিতে পারবো। আপাতত কিছুক্ষণ অন্তত এক সাথে থাকছি আমরা।
এর পর অদ্ভুত এক ধরনের পালকি নিয়ে এলো ওরা। মানুষের বদলে ঘোড়ায় বহন করে ওগুলো। সামনে পেছনে দুটো লম্বা দণ্ডের সাথে জুড়ে দেয়া হয় একটা করে দুটো টাটু ঘোড়া। আমরা উঠে বসতেই সিমব্রি ইশারা করলো। সামনের টাটুর লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো দাসরা। পেছনে পড়ে রইলো বিষণ্ণ প্রাচীন তোরণগৃহ।
পথের প্রথম মাইলখানেক গেছে আঁকাবাকা এক গিরিখাতের মাঝ দিয়ে। তারপর আচমকা একটা মোড় নিলো গিরিপথ। সামনে ভেসে উঠলো কালুনের বিস্তৃত সমভূমি। কয়েক মাইল দূরে একটা নদী। সেদিকেই যাচ্ছি আমরা। নদীটা সরু কিন্তু খরস্রোতা। ওপাশেজাবার সমভূমি। যতদূর চোখ যায় ফাঁকা আর ফাঁকা। একটাই মাত্র ব্যতিক্রম এই একঘেয়ে বিস্তারের মাঝে—সেই পাহাড়টা, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে অগ্নি-গৃহ। এখান থেকে অনেক দূরে সেটা। একশো মাইলেরও বেশি হবে। এতদূর থেকেও পাহাড়টার গাম্ভীর্যপূর্ণ অবয়ব টের পেতে অসুবিধা হয় না। চূড়াটা কমপক্ষে বিশ হাজার ফুট উঁচু। উজ্জ্বল সাদা।