দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এগিয়ে আসছে খানিয়া। পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি! এবং তারপর-হ্যাঁ, এদিকে না এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো সে।
এখন কি করবো? লিওর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা বৃথা। ফিরে যাবো? না, খানিয়াকে অনুসরণ করবে। ধরা পড়লে একই অজুহাত দেখাবো। কিছু হয়তো জানা যাবে, অথবা—অথবা, বুকে গেঁথে বসবে ছোরা।
কয়েক সেকেণ্ড পর মোড় নিয়ে আমি উঠতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে এক পাশে একটা দরজা দেখলাম। বন্ধ। অত্যন্ত প্রাচীন। জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। ফাটল দিয়ে আলো এসে পড়েছে বাইরে। দরজায় কান লাগাতেই শুনতে পেলাম সিমব্রির কণ্ঠস্বর: কিছু জানতে পারলে, ভাইঝি?
সামান্য। খানিয়া আতেনের জবাব। খুব সামান্য।
হঠাৎ করেই সাহস বেড়ে গেল আমার। ঝুঁকে চোখ রাখলাম দরজার এক ফাটলে। ছাদ থেকে ঝোলানো একটা বড় লণ্ঠনে আলোকিত ঘরটা। টেবিলের সামনে বসে আছে সিমব্রি। খানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ভর দিয়েছে টেবিলের কোনায়। গোলাপী রঙের রাজকীয় আলখাল্লায় সত্যিই অপরূপা লাগছে তাকে। ভুরুর একটু উপরে ছোট্ট একটা সোনার মুকুট। তার নিচ থেকে কোঁকড়া চুলগুলো ঢেউয়ের মতো নেমে এসেছে কাঁধে বুকে, পিঠে। তার দিকে তাকিয়ে আছে শামান সিমব্রি; চোখে ভয়, সন্দেহ।
কি আলাপ হলো তোমাদের? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।
ওরা কেন এসেছে জিজ্ঞেস করলাম, ও জবাবে বললো, খুব সুন্দরী এক মহিলার খোঁজে এসেছে–আর কিছু বললো না। সেই মহিলা আমার চেয়ে সুন্দরী কিনা জানতে চাইলাম, তখন ওঁ জবাব দিলো, তা বলা শক্ত, তবে সে নাকি অন্য রকম। নিশ্চয়ই ভদ্রতা করে এই জবাব দিয়েছে ও। যা হোক, তারপর আমি, বললাম আমার চেয়ে সুন্দরী কোনো নারী কালুনে নেই, তাছাড়া আমি এদেশের রানী এবং আমিই ওকে বাঁচিয়েছি পানি থেকে। আমি আরও বলেছি, সে যাকে খুঁজছে আমিই সে।
বেশ বেশ, অস্থির ভাবে বললো সিমব্রি। তারপর?
তারপর ও বললো, তুমি কখনও আগুনের ভেতর দিয়ে এসেছো?
আমি বললাম,যা, আত্মার আগুনে আমি স্নান করেছি।
ও তখন বললো, তোমার চুল দেখাও তো আমাকে।
আমি আমার একগুচ্ছ চুল তুলে দিলাম ওর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ও ফেলে দিল ওগুলো। গলার সঙ্গে ঝোলানো ছোট একটা চামড়ার থলে থেকে আরেক গুচ্ছ চুল বের করলো—ওহ! সিমব্রি, কাকা, অমন সুন্দর চুল আমি আর কখনও দেখিনি। রেশমের মতো কোমল, মসৃণ; লম্বায় আমার এই মুকুট থেকে পা পর্যন্ত হবে।
তোমার চুল সুন্দর, ও বললো, কিন্তু দেখ, এগুলোর মতো নয়।
আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে, এ চুল কোনো নারীর নয়।
ও জবাব দিলো, ঠিক বলেছো, আমি যাকে খুঁজছি সে নারীর চেয়েও বেশি।
তারপর—তারপর, আমি নানা ভাবে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও আর একটা কথাও বললো না। এদিকে ঐ অজানা মেয়ে মানুষটাকে এমন ঘৃণা করতে শুরু করেছি যে শেষে কি বলতে কি বলে ফেলি ঠিক নেই, তাই ভয় পেয়ে চলে এসেছি। এখন তোমার ওপর আমার নির্দেশ, খুঁজে বের করো এই মহিলাকে। শামান সিমব্রি, দরকার হলে তোমার সকল জ্ঞান দিয়ে খুঁজবে। তারপর জানাবে আমাকে। যদি পারি, আমি খুন করবো তাকে!
আচ্ছা, সে দেখা যাবে, জবাব দিলো শামান। এখন, এই চিঠিটার ব্যাপারে কি করবে? টেবিলের ওপর পার্চমেন্টের ছোটখাটো একটা স্কুপ থেকে বিশেষ একটা বেছে নিলো বৃদ্ধ। কদিন আগে অরোস-এর কাছ থেকে যেটা এসেছে?
আরেকবার পড়ো তো, বললো আতেন। আবার শুনতে চাই, কি লিখেছে।
পড়তে শুরু করলো সিমব্রি : কালুনের খানিয়ার কাছে অগ্নিগৃহের হেসা।
বোন–এই মর্মে আমার কাছে সতর্কসংকেত পৌঁছেছে যে, পশ্চিমা বর্ণের দুই আগন্তুক আমার আশীর্বাণী লাভের আশায় তোমার দেশে আসছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি নির্দেশ দিচ্ছি, পরবর্তী চাঁদের প্রথম দিনে তুমি আর তোমার জ্ঞানী চাচা তোরণের অভিভাবক শামান সিমব্রি গিরিখাতের যে জায়গায় প্রাচীন সড়ক শেষ হয়েছে তার নিচে নদীর তীরে গিয়ে অপেক্ষা করবে। ঐ পথেই আসবে আগন্তুকরা। তুমি ওদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এবং পথ দেখিয়ে নিরাপদে আমার পাহাড়ে নিয়ে আসবে। ওরা যদি ঠিক মতো এখানে না পৌঁছায় তাহলে তার সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাদের দুজনকে। আমি নিজেই ওদের আনতে যেতে পারতাম, কিন্তু তা অতীতে সম্পাদিত চুক্তির পরিপন্থী। তাই তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিতে হচ্ছে। আশাকরি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হবে।
হেসা অপেক্ষা করছে! পার্চমেন্টটা নামিয়ে রাখতে রাখতে সিমব্রি বললো। তারমানে নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা।
হ্যাঁ, নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা, আমার হৃদয়ও অপেক্ষা করছে ওদের এক জনের জন্যে। ও যে নারীর কথা বলছে সে হেসা নয়।
অনেক নারী আছে ঐ পাহাড়ে, তাদের কারও কথাও বলে থাকতে পারে।
যার কথাই বলুক না কেন, ও-পাহাড়ে যাচ্ছে না।
যা ভাবছো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে হেসা। এই নরম কথাগুলোর আড়ালে ভয়ানক এক হুমকি রয়েছে, বুঝতে পারছো না?
হুমকি থাক আর না থাক ও যাচ্ছে না। অন্যজন ইচ্ছে হলে যেতে পারে।
আতেন, স্পষ্ট করে বলো তো, তোমার ইচ্ছা কি? প্রেমিক হিসেবে চাও লিও নামের লোকটাকে?
বৃদ্ধ শামানের চোখে চোখে তাকালো খানিয়া। দৃঢ় গলায় জবাব দিলো—