ঐ মঠের প্রধান কে, খানিয়া? এক পূজারিণী?
হ্যাঁ, এক পূজারিণী, তার মুখ আমি কখনও দেখিনি। ও এত বুড়ি যে সব সময় ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে রাখে।
আঁ! ঘোমটা টেনে রাখে! অনুভব করছি শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছে আমার। বেশ ঘোমটা টানুক আর না-ই টানুক, আমরা যাবো ওঁর কাছে। আশাকরি উনি আমাদের স্বাগত জানাবেন।
না, তোমরা যাবে না, কাটা কাটা গলায় বললো আতেন। সেটা বেআইনী। তাছাড়া, আমি তোমাদের রক্তে হাত রাঙাতে চাই না।
কে বেশি ক্ষমতাবান? ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি খানিয়া, না ঐ পাহাড়ের পূজারিণী?
আমিই বেশি ক্ষমতাবান, হলি-তা-ই তো তোমার নাম না কি? প্রয়োজনের মুহূর্তে আমি ষাট হাজার যোদ্ধাকে জড়ো করতে পারি, কিন্তু ওর কিছু জংলী আর সন্ন্যাসী ছাড়া কিছু নেই।
তলোয়ারই পৃথিবীর একমাত্র শক্তি নয়, খানিয়া। এখন বলুন, এই পূজারিণী কখনও আপনাদের কালুন-এ এসেছেন?
না। বহু শতাব্দী আগে মঠ আর সমভূমির মানুষদের ভেতর এক যুদ্ধ হয়েছিলো। একটা চুক্তির মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধের শেষ হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছিলো ও কখনও নদীর এপারে আসবে না, কোনো খান বা খানিয়াও ওর পাহাড়ে উঠবে না। যে কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আমাদের ভেতর।
তাহলে কে আসল প্রভু? কালুনের খান, না ঐ মঠের প্রধান? আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ধর্মীয় বা ঐশী ব্যাপার-স্যাপারে হেস-এর পূজারিণী, আর জাগতিক ব্যাপারে কালুনের খান।
খান। তার মানে আপনি বিবাহিত?
হ্যাঁ! তীব্র রোষে জ্বলে উঠলো আতেনের চোখ! এবং এর মধ্যে নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছে ও একটা পাগল। ওকে আমি ঘৃণা করি।
আঁ,…শেষেরটা একটু আন্দাজ করেখানিয়া।
অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো আতেন।
কে? আমার চাচা শামান বলেছে? না, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, তুমি দেখেছো। তোমাকে হত্যা করাই উচিত ছিলো। ওহ! আমার সম্পর্কে কি ভেবেছে তুমি?
কি জবাব দেবো ভেবে পেলাম না।
নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করে বসেছে আমি পুরুষ দেখলেই লালায়িত হই, বলে চললো সে। কিন্তু না আমি-আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। আমি কালুনের খানিয়া, ওরা নাম দিয়েছে বরফ-হৃদয়, হ্যাঁ, বলতে লজ্জা নেই, আমি তা-ই। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো আতেন।
না, আমি বললাম, অমন কিছু আমি ভাবিনি। সত্যিই যদি আপনি তেমন কিছু করে থাকেন, আমার ধারণা তার পেছনে যথার্থ কারণ আছে।
একটু শান্ত হলো খানিয়া। হ্যাঁ, বিদেশী, কারণ আছে। অনেক কিছু তুমি জেনে ফেলেছো, এটুকুই বা বাকি থাকবে কেন? শোনন, আমার ঐ স্বামীর মতো আমিও পাগল হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গীকে যখন প্রথম দেখি তখনই পাগলামি ঢুকে পড়েছে আমার ভেতরে। এবং আমি—আমি—
ওকে ভালোবেসে ফেলেছেন, এই তো? এটা কোনো পাগলামি নয়। যে কোনো সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হলো ভালোবাসা।
না না, তুমি বুঝতে পারছে না, এ নিছক ভালোবাসা নয়, আরও বেশি কিছু। কি করে তোমাকে বোঝাবো? নিয়তি আমাকে বাধ্য করেছে–আমি ওর, একমাত্র ওর। হ্যাঁ, আমি ওর, এবং শপথ করে বলছি, ও আমার হবে।
বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে চলে গেল খানিয়া আতেন। আর আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই খানিয়া? এর সাথে লিওর আচরণ কি হবে?
.
তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এর ভেতরে খানিয়াকে আর দেখিনি। শামান সিমব্রির কাছে শুনেছি, সে নাকি রাজধানীতে গেছে, রাজকীয় অতিথি হিসেবে বরণ করবে আমাদের। লিওর সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম বৃদ্ধকে। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে সে জানিয়ে দিয়েছে, আমাকে ছাড়াই ভালো আছে আমার পালিত পুত্র। শেষে পকেট হাতড়ে এক টুকরো কাগজ পেয়ে তাতে একটা চিরকুট লিখে লিওর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করেছি। ভৃত্যদের কেউ সেটা স্পর্শ করতেও রাজি হয়নি। অবশেষে তৃতীয় রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, যা থাকে কপালে, দেখা করার চেষ্টা করবো ওর সাথে।
ইতিমধ্যে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছি। মাঝরাতে, চাঁদ যখন মাথার ওপর উঠে এসেছে, পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে কাপড়-চোপড় পরে নিলাম। আমার কাপড়ের ভেতর ছুরিটা এখনও আছে দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম মনে। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম দরজা খুলে।
লিও আর আমাকে প্রথমে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে যখন বয়ে আনা হয় তখন চোখ বুজে আমি পথের নিশানা মনে গেঁথে নিয়েছিলাম। মনে আছে, আমার এখানকার ঘর থেকে বেরিয়ে তিরিশ পা (বাহকদের পদক্ষেপ গুনেছিলাম) যাওয়ার পর বাঁ দিকে মোড় নিতে হয়। তারপর আরও দশ পা গিয়ে একটা সিঁড়ির পাশ দিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই আমাদের পুরনো ঘর।
দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে চললাম আমি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, তবু বায়ের মোড়টা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। গুণে গুণে দশ পা গিয়ে ডানে মোড় নিলাম। পর মুহূর্তে ছিটকে পিছিয়ে আসতে হলো আমাকে। লিওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খানিয়া নিজে। এক হাতে প্রদীপ, অন্য হাতে তালা লাগাচ্ছে দরজায়।
প্রথমেই আমার চিন্তা হলো, ছুটে চলে যাই নিজের ঘরে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারলাম, লাভ হবে না। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ভালো। সত্যি কথাই বলবো, কেমন আছে জানার জন্যে লিওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।