নিশ্চয়ই ধরার জন্যে গিয়েছিলাম—তবে মাছ নয় মানুষ। দুটো ধরেছিও।
আগে থাকতেই জানতেন আমরা আসবো?
অনেকটা। অতি সম্প্রতি আমাকে জানানো হয়েছে তোমরা আসছে। দিনক্ষণ অবশ্য বলা হয়নি। তোমাদের অপেক্ষাতেই আমরা ছিলাম ওখানে। এখন বলো তো, ঐ দুর্গম পথ পেরিয়ে এলে কি করে?
ধরুন আমরা যাদু জানি।
জানি না। জানতেও পারো। কিন্তু কি খুঁজছে তোমরা? তোমার সঙ্গী এক রানীর কথা বলছিলো…।
সত্যিই? ও বলছিলো? আশ্চর্য! এক রানীর খোঁজ তো ও পেয়েই গেছে। আমাদের যে বাঁচিয়েছে সে নিশ্চই রানী, ন।
হ্যাঁ। খুব বড় রানী। আমাদের দেশে খানিয়া মানেই রানী। কিন্তু, বন্ধু হলি, অচেতন একজন মানুষ একথা জানলো কি করে বুঝতে পারছি না। আর আমাদের ভাষা-ই বা তোমরা শিখলে কোথায়?
খুব সোজা, ভাষাটা প্রাচীন। আমাদের দেশে এখনও এর চর্চা হয়। গ্রীসের মানুষ এখনও এ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এই দুর্গম এলাকায় এ ভাষা এলো কি করে?
বলছি শোনো, শুরু করলো বৃদ্ধ। অনেক অনেক পুরুষ আগে এ-ভাষায় কথা বলে এমন এক জাতির মাঝে মহান এক দিগ্বিজয়ীর জন্ম হয়েছিলো। দেশ জয় করতে করতে আমাদের দেশের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর ভাগ্যদেবী বিমুখ হলেন। স্থানীয় এক জাতির কাছে পরাজিত হলেন তিনি। কিন্তু তার-ই এক সেনাপতি—এই সেনাপতি অবশ্য অন্য এক গোত্রের লোক, অন্যপথে এসে জয় করে নিলেন দেশটা। সেই সাথে তার প্রভুর ভাষাও এলো। এদেশে এক নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। মরুভূমি আর দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা বলে বাইরের দুনিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ রইলো না দেশটার। এখনও নেই।
হ্যাঁ, এ গল্প আমি জানি। দিগ্বিজয়ীর নাম আলেকজাণ্ডার তাই না?
হ্যাঁ। আর সেই সেনাপতির নাম র্যাসেন, মিশর নামের এক দেশের লোক তিনি। তারই বংশধররা এখনও শাসন করছে এ দেশ।
এই সেনাপতি, যার নাম বলছেন র্যাসেন, তিনি আইসিস নামের এক দেবীর উপাসক ছিলেন না?
না, জবাব দিলো বৃদ্ধ শামান সিমব্রি। সেই দেবীর নাম হেস।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আইসিসেরই আরেক নাম হেস। একটা কথা বলুন তো, এখনও কি তার উপাসনা হয় এদেশে? জানতে চাইছি, কারণ, আইসিসের নিজের দেশ মিশরেই এখন তাঁর পূজা বন্ধ হয়ে গেছে।
ওদিকের ঐ নিঃসঙ্গ পাহাড়ে একটা মন্দির আছে। ঐ মন্দিরের পূজারী পূজারিণীরা কিছু প্রাচীন অনুশাসনের চর্চা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রকৃত দেবতা র্যাসেনের বিজয়ের আগে যা ছিলো এখনও তা-ই আছে—ঐ পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা আগুন।
ওখানে এক দেবী আছেন না?
শীতল চোখে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ। তারপর জবাব দিলো, কোনো দেবীর কথা আমি জানি না। ওটা পবিত্র পাহাড়। ওর রহস্য জানতে চাওয়া মানে মৃত্যু। এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?
প্রাচীন ধর্মমতগুলোর ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল আছে তাই।
ভালো কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে পরামর্শ দেবো, কৌতূহল দমন করো। নইলে অহেতুক মরণ-শ্বাপদ বা জংলীদের বল্লমের মুখে প্রাণ হারাবে।
মরণ-শ্বাপদটা আবার কি?
এক ধরনের কুকুর। যারা খানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় আমাদের সনাতন প্রথা অনুযায়ী তাদের ছেড়ে দেয়া হয় ঐ কুকুরের মুখে।
খান! আপনাদের এই খানিয়ার স্বামী আছে তাহলে?
হ্যাঁ। ওরই চাচাতো ভাই। দেশের অর্ধেকের শাসক ছিলো ও। এখন ওরা এক, ওদের রাজ্যও এক। কিন্তু যথেষ্ট কথা বলে ফেলেছো, আর না। তোমার খাবার তৈরি। চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালো বৃদ্ধ।
আর একটা প্রশ্ন, বন্ধু সিমব্রি। আমি এঘরে এলাম কি করে? আর আমার সঙ্গী-ই বা কোথায়?
যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। দেখতেই পাচ্ছো তাতে তোমার উপকার হয়েছে। কিছু মনে নেই তোমার?
একেবারেই না। আমার বন্ধু কোথায় বললেন না?
ভালোই আছে। খানিয়া আতেন ওর সেবা-শুশ্রুষা করছে।
আতেন! এ নাম তো প্রাচীন মিশরে প্রচলিত ছিলো। এ নামের এক মহিলার কথা পড়েছি, হাজার হাজার বছর আগে সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত ছিলো।
আমার ভাইঝি আতেন কি সুন্দরী নয়?
কি করে বলবো? কয়েক মুহূর্তের জন্যে মাত্র দেখেছি। তা-ও কি অবস্থায় তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে? আমার এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শামান সিমব্রি। ভৃত্যরা আমার খাবার নিয়ে এলো। একটু পরে আবার দরজা খুলে গেল। খানিয়া আতেন ঢুকলো ঘরে। সঙ্গে কোনো রক্ষী নেই। ওকে দেখেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম আমি। মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। আমার মনের ভাব যেন বুঝতে পারলো সে। বললো-শুয়ে থাকো, ভয়ের কিছু নেই। অন্তত এই মুহূর্তে আমি তোমার কোনো অনিষ্ট করবো না। এখন বলো, ঐ লোকটা, লিও, তোমার কে? ছেলে? উঁহু,বলতে হচ্ছে বলে দুঃখিত, অন্ধকার থেকে আলোর জন্ম হতে পারে না।
আমি অবশ্য তা-ই ভেবে এসেছি সারাজীবন। যা হোক, আপনার ধারণাই ঠিক, খানিয়া। ও আমার পালিত পুত্র।
এখানে কি জন্যে, কি খুঁজতে এসেছো? জিজ্ঞেস করলো খানিয়া।
আমরা খুঁজছি–আঁ.., ঐ পাহাড়ে ভাগ্য আমাদের যা পাইয়ে দেয়।
একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল আতেনের মুখ। তবু শান্তগলায় বললো, ওখানে শাস্তি ছাড়া কিছু পাবে না, অবশ্য যদি ও পর্যন্ত পৌঁছুতে পারো। আমার ধারণা তার আগেই জংলীদের হাতে মারা পড়বে। জংলীরা ঐ পাহাড়ের ঢাল পাহারা দেয়। হেস-এর মঠ ওখানে। ঐ মঠের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু, অনন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে।