ও! দয়া করো, দয়া করো। হাতের মতো গলাটাও কাঁপালাম নিখুঁত ভাবে। আমাকে একটু পানি দাও! জ্বর! জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা! উদভ্রান্তের মত চাইলাম চারপাশে। একটু চড়লো আমার গলা। কই, একটু পানি দাও! অভিভাবক, কই তুমি, একটু পানি দাও, পানি। তারপর ধপাস করে পড়ে গেলাম চিৎ হয়ে।
থেমে দাঁড়ালো খানিয়া। ছোরাটা খাপে পুরলো। পাশের একটা টেবিল থেকে এক বাটি দুধ নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমার বিছানার পাশে। ঝুঁকে আমার ঠোঁটের কাছে ধরলো বাটিটা। ঘাড়টা সামান্য তুলে বুভুক্ষের মতো খেয়ে নিলাম দুধটুকু। দুধের স্বাদ এর চেয়ে খারাপ আর কোনোদিন লাগেনি আমার কাছে।
তুমি দেখি কাপছে! বললো সে। দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
হ্যাঁ, বন্ধু। দেখলাম, ঐ ভয়ানক অন্ধকার খাদের ভেতর পড়ে যাচ্ছি আমি।
আর কিছু?
আর কি দেখব? নদীতে পড়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল।
সত্যি বলছো, আর কিছু দেখনি?
শপথ করে বলছি, রানী।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্ঞান হারানোর ভান করলাম।
সত্যিই আমি আবার অচেতন হয়ে গেছি মনে করে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করলো বানিয়া।
ওহ কি শান্তি, বললো সে, লোকটা অন্য কোনো স্বপ্ন দেখেনি। না হলে মুশকিলই হতো-ওর জন্যেও, আমার জন্যেও। অত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে বেচারা, মরণ-শ্যপদের হাতে তুলে দিতে খারাপই লাগতো আমার। বুড়ো আর কুশ্রী হলেও মনে হয় জ্ঞানী লোকটা।
মরণ-শ্বাপদ জিনিসটা কি বুঝলাম না, তবু কথাটা শুনে কেমন একটা শিরশিরানি অনুভূতি হলো আমার শরীরে। ভয়ে শক্ত হয়ে রইলাম। এমন সময় সিঁড়িতে অভিভাবকের পদশব্দ শুনে স্বস্তি ফিরে এলো মনে। চোখ সামান্য ফাঁক করে দেখলাম, ঘরে ঢুকে রমণীকে কুর্নিশ করলো সে।
অসুস্থ দুজনের অবস্থা এখন কেমন, ভাতিঝি? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।
এখনও অচেতন। দুজনই।
তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ওরা বুঝি জেগে উঠেছে।
কি শুনেছো তুমি, শামান (অর্থাৎ যাদুকর)? আচমকা প্রশ্ন করে বসলো খানিয়া, গলার স্বর কঠোর।
আমি? কি আবার শুন্বো। খাপের ভেতর ছুরি ঢোকানোর শব্দ শুনলাম একবার, তারপর দূরে মরণ-শ্বাপদের ডাক।
আর, কি দেখেছো তোমার ঐ তোরণের ভেতর দিয়ে?
আশ্চর্য দৃশ্য, খানিয়া, ভাইঝি। অচেতন অবস্থায় উঠে বসে মানুষ!
হ্যাঁ। সুতরাং ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই এটাকে অন্য কামরায় নিয়ে যাও। অন্যজনের একটু বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।
চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে অভিভাবকের মুখে। একটু আগে ওর উপস্থিতিতে যে স্বস্তিটুকু পেয়েছিলাম তা উবে গেল।
কোন্ কামরায়, খানিয়া? অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো সে।
আমার মনে হয় স্বাস্থ্যকর কোনো একটায়; যেখানে ও দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। লোকটা বুদ্ধিমান। তাছাড়া পাহাড়ের নির্দেশ, ওর কোনো ক্ষতি হলে বিপদ হবে।
দরজার কাছে গিয়ে শিস বাজালো অভিভাবক। তক্ষুণি ভৃত্যদের পদশব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে। বৃদ্ধ কিছু একটা নির্দেশ দিলো তাদের। আলগোছে আমাকে সুদ্ধ জাজিমটা তুলে নিলো ওরা। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, নেমে, আবার হেঁটে অবশেষে আরেকটা বিছানায় নামিয়ে রাখলো আমাকে। বৃদ্ধ শামান আমার নাড়ী দেখলো। তারপর সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম আমি।
ঘুম যখন ভাঙলো তখন পুরো দিন। যথেষ্ট ভালো বোধ করছি। মাথা পরিষ্কার, শরীর ঝরঝরে। বহু দিন এত ভালো বোধ করিনি। আগের রাতের সব কথা মনে পড়ে গেল। সাবধানে মনে মনে যাচাই করলাম সেগুলো। সব শেষে সিদ্ধান্তে এলাম, আমার বিপদ এখনও কাটেনি। হয়তো শুরু হয়েছে মাত্র।
.
অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেলাম না। মরণ-শ্বাপদের ডাক মানে কি? আমাদের উদ্দেশ্য কি সিদ্ধির পথে? এই মহিলা-মানে খানিয়া-ই কি আয়শা? কেন ও আলিঙ্গন করলো লিওকে? নিঃসন্দেহে মেয়েটা দুশ্চরিত্রা নয়, তাছাড়া দুশ্চরিত্রা হলেও জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থান করছে এমন এক অপরিচিত লোককে আলিঙ্গন করা বোধহয় কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। যা ও করেছে, সত্যি সত্যি অবদমিত আবেগের উচ্ছাসেই করেছে। তাহলে?
নাকি খুবিলগান কোউ-এন-এর কথাই ঠিক? আইসিসের পূজারী ক্যালিক্রেটিস যার সঙ্গে পালিয়েছিলো সেই মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে? আমেনার্তাস আর এই নিয়া যদি একই নারী হয় তাহলে কি এবার অশুভের খেলা শুরু হবে? জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্য জানতে হবে আমাকে। কিন্তু কি ভাবে।
দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ যাদুকর ঢুকলো ঘরে কৃত্রিম একটা হাসি লেগে আছে ঠোঁটে। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
.
০৭.
কেমন আছো, বিদেশী? জিজ্ঞেস করলো শামান।
ভালো, জবাব দিলাম। অনেক ভালো—কিন্তু আপনার নামটা তো এখনও জানা হলো না।
সিমব্রি। আর আমার পদবী তো আগেই বলেছি, তোরণের অভিভাবক। বংশানুক্রমে আমরা এই পদবীর অধিকারী। পেশায় চিকিৎসক।
চিকিৎসক! আমি তো মনে করেছিলাম আপনি যাদুকর।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সিমব্রি। না, যাদুকর না, চিকিৎসক। তোমাদের ভাগ্য ভালো, এ বিষয়ে আমার কিছু পারদর্শিতা আছে, না হলে আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে না। যাক, তোমার নামটা এবার বলো।
হলি।
আহ, হলি!
আপনি কি আগেই টের পেয়েছিলেন আমরা আসবো, তাই খানিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ে? এ ছাড়া তো আর কোনো কারণ দেখছি না। সে জন্যেই মনে হলো আপনি হয়তো যাদুকর, গণাপড়া করে আগেই ভবিষ্যৎ। জেনে যান। অবশ্য নিছক মাছ ধরার জন্যেও গিয়ে থাকতে পারেন, ঠিক জানি না।