একটানা কয়েক সপ্তাহ কাটলো কখনও অচেতন, কখনও অর্ধচেতন ভাবে। সম্পূর্ণ সচেতন একবারও হইনি এই সময়ে। যে সময়গুলোয় অর্ধচেতন ছিলাম তখনকার স্মৃতি কিছু কিছু মনে আছে। এছাড়া আর সব শূন্য, অন্ধকার।
একদিনের কথা একটু একটু মনে পড়ে। হলদে মুখো সেই বুড়ো বুকে আছে আমার ওপর, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সাদা চুল দাড়িতে অশরীরী আত্মার মতো লাগছে তাকে। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে, আমার মনে যত গোপন কথা সবুয়েন জেনে নেবে।
এরাই সেই লোক, বিড়বিড় করে বললো সে। কোনো সন্দেহ নেই, এরাই। তারপর জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আকুল নয়নে তাকিয়ে রইলো। আকাশের দিকে।
আরেক দিনের কথা মনে আছে, নারীকণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার—সেই আগের মতো ঘুম ভাঙা, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব, যেন স্বপ্ন দেখছি। চোখ মেলে দেখলাম আমাদের বাঁচিয়েছিলো যে, সেই রমণী। ভারি একটা আলখাল্লা পরনে, দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। আমার মুখের দিকে তাকালো। বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভুরু। মুখ ফিরিয়ে অভিভাবককে কি যেন বললো। সম্ভবত আমার কুৎসিত চেহারার কথা। তারপর লঘু পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো লিওর বিছানার পাশে। খটখটে একটা কাঠের টুল টেনে বসলো। ভয়ঙ্কর একাগ্রতায় তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
অনেক, অনেকক্ষণ দেখলো সে লিওকে। তারপর উঠে পায়চারি করতে লাগল কামরার এমাথা ওমাথা। হাত দুটো ভাজ করে রাখা বুকের ওপর, কুঁচকে আছে ভূদুটো, মুখে তীব্র এক আকুতি; যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে, পারছে না।
কোথায়, কখন? নিজের মনে ফিসফিস করলো সে। ওহ! কোথায়, কবে?
এই দৃশ্যের শেষে কি ঘটেছিলো জানে না। কারণ আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি।
আবার, কঘণ্টা বা কত দিন পরে জানি না, একটু সজাগ হলাম আমি। তখন রাত। শুধু মাত্র চাঁদের আলোয় সামান্য আলোকিত ঘরটা। লিওর বিছানায় সরাসরি পড়েছে আলো। সেই আলোয় দেখলাম, বিছানার পাশে বসে আছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে লিওর মুখের দিকে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে। ও দেখছে লিওকে, আমি দেখছি ওকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো মেয়েটা। ঘুমের ভান করে চোখ বুজে ফেললাম আমি।
সম্পূর্ণ সজ্ঞান না হলেও কৌতূহল জেগেছে আমার মনে। কে এই নারী, তোরণের অভিভাবক যাকে বলেছে কালুন-এর খানিয়া? আমরা যাকে খুঁজছি এ-কি সে-ই? কেন নয়? কিন্তু…আয়শাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তো চিনতে পারার কথা ছিলো আমাদের। ওর সেই মুখ কি ভোলা যায়?
আবার লিওর বিছানার কাছে চলে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসলো। আগের মতোই অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। নিঃশব্দে কেটে গেল কিছুক্ষণ। তারপর সে কথা বলতে শুরু করলো। খুব নিচু স্বরে, মঙ্গোলিয়ানের মিশেল দেয়া গ্রীকে।
আমার স্বপ্নের পুরুষ, ফিসফিস করে বললো সে। কোত্থেকে এসেছো? কে তুমি? হেসা কেন আমাকে আদেশ দিলো তোমার সাথে দেখা করার? এর পরের কয়েকটা বাক্য আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর আবার, তুমি ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ভেতর তোমার চোখ খুলে গেছে। আমার কথার জবাব দাও, আমি জানতে চাইছি, তোমার আর আমার মাঝে কিসের বন্ধন? কেন আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি? কেন তোমাকে আমার চেনা চেনা মনে হয়। কেন? মিষ্টি কণ্ঠস্বরটা মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
ঝুঁকে পড়ল সে লিওর ওপর। এক গুচ্ছ চুল মূল্যবান মণিখচিত ফিতের বাঁধনচ্যুত হয়ে পড়ল ওর মুখে। জেগে উঠলো লিও। আমি যেমন জেগে, আধো ঘুম আধো জাগরণ, তেমন। ও হাত বাড়িয়ে ছুঁলো চুলের গোছাটা। তারপর ইংরেজিতে বললো–কোথায় আমি? ও, মনে পড়েছে, ওঠার চেষ্টা করতেই রমণীর চোখে চোখ পড়লো ওর। তখন আবার গ্রীকে বললো, তুমিই তো আমাকে খরস্রোতা নদী থেকে বাঁচিয়েছিলে। বলো, তুমিই কি সেই রানী যাকে আমি এদিন ধরে খুঁজছি?
জানি না, কাঁপা কাঁপা মৃদু মিষ্টি স্বরে জবাব দিল রমণী। এটুকু জানি, আমিও রানী-অবশ্য খানিয়াকে যদি রানী বলা যায়।
তাহলে বলো, রানী, আমাকে মনে আছে তোমার?
স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়েছিলো, সে বললো, আমার মনে হয় দূর অতীতে কোনো এক সময় আমাদের দেখা হয়েছিলো। হা, নদীর কূলে যখন প্রথম তোমাকে দেখি, তখনই জেনেছিলাম-বিদেশী, অপরিচিত কিন্তু মুখটা চেনা চেনা লাগছিলো। বলো, তোমার নাম কি?
লিও ভিসি।
মাথা নাড়ল রমণী। না, এ নাম তো আমার পরিচিত নয়, তবু আমি তোমাকে চিনি।
তুমি আমাকে চেনো? কেমন করে? ভারি, জড়িত গলায় বলেই আবার ঘুমিয়ে গেল লিও।
গভীর মনোযোগের সাথে আবার কিছুক্ষণ দেখলো ওকে খানিয়া। তারপর হঠাৎ আস্তে আস্তে নেমে যেতে লাগলো তার মুখ। লিওর ঠোঁটের সাথে ঠোঁট লাগলো। হাত দুটো উঠে এলো আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে। পরমুহূর্তে ছিটকে সরে এলো সে। চুল পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে লজ্জায়।
এবার আমার দিকে চোখ পড়লো তার।
কখন যে সম্মোহিতের মতো উঠে বসেছি আমি নিজেও টের পাইনি। এস্ত পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো সে।
তোমার এত সাহস? তীব্র বিদ্বেষ ভরা ফিসফিসে গলায় বললো রমণী। দ্রুত হাতে কোমরের কাছ থেকে টান দিলো কি যেন। পরক্ষণে দেখলাম, তার হাতে চক চক করছে একটা ছোরা। যে-কোনো মুহূর্তে ছুটে আসবে আমার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। বিপদ বুঝতে বিলম্ব হলো না আমার। ওকে এগোতে দেখেই কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিলাম সামনে।