শ্বাস-প্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতে মুখ তুলে তাকালাম আমি। দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাপড় থেকে পানি ঝরে পড়ছে টপ টপ করে। লিওর দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখে স্বপ্নাচ্ছন্নের দৃষ্টি। কপালের কোনায় একটা কাটা দাগ, একটু আগে ধস্তাধস্তির সময় হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে। তবু তার সৌন্দর্য আমার চোখ কাড়লো। সংবিৎ ফিরলো মেয়েটার। চকিতে একবার তাকাল তার ভরাট শরীরের সাথে সেঁটে থাকা পোশাকের দিকে। সঙ্গীকে কি যেন বলে দ্রুত ছুটে চলে গেল একটা পাহাড়ের আড়ালে।
আমরা শুয়ে আছি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। পাশে বসে আছে বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে। ভাষাহীন দৃষ্টি আমাদের ওপর নিবদ্ধ। মৃদু স্বরে কিছু বললো। ভাষাটা বুঝতে পারলাম না আমরা। এরপর অন্য একটা ভাষায় কথা বললো সে। এবারও তা দুর্বোধ্য শোনালো আমাদের কানে। তৃতীয়বার চেষ্টা করলো বৃদ্ধ। সাথে সাথে কান খাড়া হয়ে উঠল আমাদের। গ্রীক! হ্যাঁ, মধ্য এশিয়ার এক অজ এলাকায় গ্রীক-এ কথা বলছে অশীতিপর এক বৃদ্ধ! খুব বিশুদ্ধ নয় যদিও, তবু গ্রীক।
তোমরা কি যাদুকর? বললো সে, জ্যান্ত পৌঁছেছে এদেশে!
না, জবাব দিলাম আমি, একই ভাষায়। তা-ই যদি হতো তাহলে অন্য রাস্তায় আসতাম।
প্রাচীন ভাষাটা জানে ওরা! পাহাড়ের ওপর থেকে যা বলে দেয়া হয়েছে তার সাথে মিলে যাচ্ছে! নিজের মনে বিড়বিড় করলো বৃদ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো–
কি চাও তোমরা, বিদেশী?
সাথে সাথে কোনো জবাব দিলাম না আমি। ভাবছি কি বলবো সত্যি কথা বললে যদি আবার ঠেলে ফেলে দেয় ঐ ভয়ঙ্কর নদীতে! কিন্তু লিও অত ভাবনা চিন্তার ধার ধারলো না।
আমরা খুঁজছি, সরাসরি বললো ও। আমরা খুঁজছি অগ্নি-পর্বত, যার চূড়া জীবনের প্রতীক দিয়ে শোভিত।
নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লোকটা। তার মানে তোমরা জানো! কাকে চাও ওখানে?
উঠে বসলো লিও। ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলো, রানীকে।
আমার ধারণা পূজারিণী বা দেবী বোঝাতে চেয়েছে লিও, কিন্তু গ্রীক-এ রানী ছাড়া আর কোনো শব্দ আসেনি ওর মাথায়।
ও! তোমরা একজন রানীকে খুঁজছে…তারমানে তোমাদের ওপর নজর রাখার জন্যেই আমাদের পাঠানো হয়েছে! না,..কি করে আমি নিশ্চিত হবো?
এটা একটা জিজ্ঞাসাবাদের সময় হলো? রেগে গেলাম আমি। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন: আপনি কে?
আমি? শোনো বিদেশীরা, আমার পদবী হলো তোরণের অভিভাবক, আর আমার সাথে যে মহিলাকে দেখলে সে হচ্ছে কালুন-এর খানিয়া।
এই সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল লিওর। টলে উঠে পড়ে যেতে লাগলো। লাফিয়ে উঠে ধরলাম আমি ওকে।
লোকটা দেখি অসুস্থ! ব্যস্ত কণ্ঠে বলল বৃদ্ধ। চলো চলো, এক্ষুণি আশ্রয় দরকার তোমাদের।
দুপাশ থেকে দুজন ধরে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম লিওকে। নদীর পাড়ে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। তারপর পাহাড়ী এলাকা। সরু আঁকাবাঁকা একটা গিরিপথ চলে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। সেই পথে চলতে লাগলাম আমরা।
গিরিপথ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই এক বনের শুরু। বন পেরিয়ে দেখতে পেলাম তোরণটা। খুব দুর্বল লাগছে বলে ভালো করে খেয়াল করতে পারলাম না ওটা। শুধু মনে আছে, দুদিকে বিস্তৃত বিরাট এক পাথুরে দেয়ালের মাঝখানে একটা গর্ত। তার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। এই গর্তের এক পাশে একটা সিঁড়ি। প্রায় অচেতন লিওকে নিয়ে অতিকষ্টে সিঁড়ির প্রথম ধাপটা উঠলাম। তারপর পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে একটা পুটুলির মতো বসে পড়লো লিও।
কি করা যায় ভাবছি এমন সময় পদশব্দ শুনে ওপর দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই রমণী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। তার পেছনে ঢিলে ঢালা পোশাক পরা দুজন মানুষ। আকর্ষণীয় কিন্তু ভাবলেশহীন চেহারা তাদের। হলদেটে ত্বক, ছোট ছোট চোখ। আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলো না তারা, যেন জানাই ছিলো আমরা আসবো। ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো মহিলা। লিওর ভারি দেহটা তুলে নিলো তারা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।
অনুসরণ করে একটা কামরায় পৌঁছুলাম আমরা। তোরণের ওপরে পাথর খোদাই করে তৈরি ঘরটা। এখানে আমাদের রেখে চলে গেল খানিয়া নামের সেই রমণী। এই কামরা থেকে আরও কয়েকটা ঘরের ভেতর দিয়ে গিয়ে অন্য একটা কক্ষে পৌঁছুলাম। দেখে মনে হলো শোয়ার ঘর। দুটো কাঠের খাট পাতা। ওপরে জাজিম, কম্বল, বালিশ। একটা খাটে শুইয়ে দেয়া হল লিওকে। বৃদ্ধ অভিভাবক ভৃত্যদের একজনের সহযোগিতায় ওর সব কাপড়-চোপড় খুলে ফেললো, আমাকেও ইশারায় বললো আমারগুলো খুলে ফেলতে। তারপর শিস বাজালো একবার।
অন্য এক ভৃত্য পাত্রভর্তি গরম পানি নিয়ে এলো। ভালো করে রগড়ে গা ধুয়ে ফেললাম আমি। লিওকে ধুইয়ে দিলো বৃদ্ধ নিজে। তারপর এক ধরনের মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো আমাদের ক্ষতগুলোয়। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। লিওকেও কম্বল চাপা দেয়া হল। এরপর খাওয়ার জন্যে সুরুয়া মতো এক ধরনের জিনিস এলো। বৃদ্ধ ওষুধ মেশালো তাতে। অর্ধেক একটা বাটিতে ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো, বাকিটা লিওর মাথা হাঁটুর ওপর নিয়ে ওর গলায় ঢেলে দিলো সে। মুহূর্তে অদ্ভুত এক উষ্ণতা বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে। যন্ত্রণাকাতর মস্তিষ্কটা হালকা হয়ে যেতে লাগলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।