.
সময় যেন থেমে গেছে। কতক্ষণ হয়েছে জানি না, সেই একই অবস্থায় আছি আমি। চারদিক নিস্তব্ধ। সামর্নে খাদের প্রায় কালো গা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তারপর, হঠাৎ একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম কালোর ভেতর, এবং মৃদু একটা শব্দ নিস্তব্ধতার ভেতর। ঝলকটা ছোরার। কোমরের খাপ থেকে খুলে এনেছে লিও। শব্দটাও বেরিয়েছে লিওর মুখ থেকেই। তীব্র আক্রোশে দুর্বোধ্য একটা চিৎকার করে চামড়ার দড়িতে ছোরা চালাচ্ছে ও। তৃতীয় পোঁচেই কেটে গেল চামড়ার সরু ফালি।
আমি দেখলাম, দুটুকরো হয়ে গেল ওটা। এক অংশ লিওকে নিয়ে চলে গেল সর্বগ্রাসী অন্ধকারের দিকে। অন্য অংশটা সৎ করে উঠে গেল ওপরে। তারপর একবার নিচে একবার ওপরে লাফাতে লাগলো দুলে দুলে।
এক সেকেণ্ড পর নিচ থেকে ভেসে এলো ভারি কিছু পতনের আওয়াজ। পেঁতলে গেল লিওর শরীর! সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম লিও আমার কাছে কি ছিলো। লিও নেই মনে হতেই সারা শরীর শিথিল হয়ে এলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরলো। শরীর টান করে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকালাম একবার চিষ্কার করে উঠলাম, আসছি, লিও! মাথার ওপর দুহাত তুলে সাঁতারু যেভাবে পানিতে ঝাঁপ দেয় সেই ভঙ্গিতে লাফিয়ে পড়লাম কালো খাদের ভেতর।
০৬-১০. শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি
০৬.
শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি। এখনও সম্পূর্ণ সচেতন আমি। যে কোনো মুহূর্তে কঠিন কিছুর ওপর আছড়ে পড়বে আমার দেহ। তারপর সব শেষ!
ঝপাং! কেন ঝপাং কেন? শব্দ তো হওয়ার কথা ধপ্ বা ধুপ! কি আশ্চর্য! আমি এখনও বেঁচে আছি! কি করে তা সম্ভব?
একটাই উত্তর, পানিতে পড়েছি।
হ্যাঁ, তাই। পানিতে পড়েছি আমি। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আর আমি ক্রমশ নিচে চলে যাচ্ছি। আরও নিচে, আরও নিচে। মনে হলো আর কখনোই বোধহয় উঠতে পারবো না এই অতল পানির তল থেকে। কিন্তু না, পারলাম শেষ পর্যন্ত। বাতাসের অভাবে ফুসফুস যখন ফেটে যাবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে পানির ওপর ভেসে উঠলো আমার মাথা।
ওহ! সে মুহূর্তের আনন্দ আমি কি করে প্রকাশ করবো? নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? কিন্তু-কিন্তু, লিও কোথায়? আমি যেমন বেঁচে গেছি ওর-ও তো তেমনি বেঁচে যাওয়ার কথা! পা দিয়ে পানি কাটতে কাটতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারদিকে।
মাত্র দশ গজ দূরে দেখতে পেলাম লিওকে। ওর সোনালি চুল আর দাড়ি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বেঁচে আছে লিও! কি অপার স্বস্তি যে অনুভব করলাম বুকের ভেতর! ও-ও আমাকে দেখেছে। হাঁ হয়ে গেছে ধূসর চোখ দুটো। এক্ষুণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে যেন।
দুজনই তাহলে বেঁচে আছি এখনও! উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো ও। খাদ উধাও! বলেছিলাম না, অদৃশ্য শক্তি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।
হ্যাঁ, কিন্তু কোথায়? বললাম আমি। তারপরেই সচেতন হলাম, আমরা একা নই। নদীর পাড়ে, আমাদের গজ তিরিশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো মূর্তি একজন পুরুষ, লম্বা একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, আর এক রমণী। লোকটা বৃদ্ধ, অত্যন্ত বৃদ্ধ, তুষারের মতো সাদা চুল দাড়ি নেমে এসেছে কাঁধ আর বুকের ওপর। ছোট খাটো কুঁজো দেহটা মোমের মতো হলুদ। সন্ন্যাসীদের মতো দীর্ঘ আলখাল্লা পরনে। লাঠিতে ভর দিয়ে মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাদের দেখছে। রমণী দীর্ঘদেহী। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে আমাদের দিকে।
এখন আমরা যেখানে আছি সেখানে নদী মোটামুটি শান্ত। অথচ তীরের কাছাকাছি মনে হচ্ছে স্রোত খুব বেশি। আন্দাজ করলাম নদী তলের অস্বাভাবিক গঠনের কারণে এমনটা হচ্ছে। দুজনে খুব কাছাকাছি থেকে পাড়ের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলাম আমরা, যেন প্রয়োজন হলে একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। সামান্য কয়েক গজ যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম প্রয়োজনটা কি প্রচণ্ড। তীরের কাছাকাছি স্রোত বেশি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা যে, কল্পনা করিনি। বন্যার তোড়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো আমাদের।
লিও চিৎকার করে উঠলো, রশিটা ধরো, আমি ডুব দিচ্ছি।
ওর কোমরে বাঁধা দড়িটা খপ করে ধরলাম আমি। প্রাণপণ চেষ্টায় ডুব সাঁতার দিয়ে তীরের দিকে যেতে লাগলো লিও। আমিও ডুব দিয়েছি। এক হাতে যতটা সম্ভব জল কেটে এগোনোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারলাম না। আমাদের গায়ের কাপড় ভিজে ভারি হয়ে উঠেছে। সীসার মতো টানছে নিচের দিকে। সেই সাথে ভয়ানক বেগে ভেসে চলেছি স্রোতের টানে।
দম শেষ হয়ে যেতেই ভেঙে উঠতে বাধ্য হলাম আমরা। একেবারে হতাশাজনক মনে হলো না পরিস্থিতি। বেশ খানিকটা চলে এসেছি তীরের দিকে। এমন সময় অবাক হয়ে দেখলাম সেই থুত্থুরে বুড়ো আশ্চর্য দ্রুত ছুটে এলো পাড়ের একেবারে কিনারে। তার দীর্ঘ লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলো আমাদের দিকে।
সর্বশক্তিতে চেষ্টা চালালো লিও। ধরে ফেলতে পারলো লাঠির এক প্রান্ত। মুহূর্তে মন্দীভূত হয়ে এলো আমাদের গতি। শ্বাস নিলাম লম্বা করে। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে বৃদ্ধ আমার দিকে। এমন সময় আবার দুর্ভাগ্য। মট করে ভেঙে গেল লাঠিটা। স্রোতের প্রবল টান অনুভব করলাম শরীরে। বৃদ্ধের হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। ধরতে পারলাম না। মুহূর্তের জন্যে দুটো হাত ছোঁয়াছুঁয়ি হলো শুধু। এই সময় অদ্ভুত এক কাজ করলো রমণী। ইতিমধ্যে সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধের পাশে। লাঠিটা ভেঙে যেতেই ঝাঁপিয়ে পানিতে নেমে এলো সে। বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়ে এক হাতে ধরে ফেললো লিওর চুল, অন্য হাতে আঁকড়ে ধরলো বৃদ্ধের একটা বাহুঁ। এই সময় ক্ষণিকের জন্যে পায়ের নিচে মাটি পেলো লিও। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো মেয়েটার ক্ষীণ কটি, অন্য হাতে আমাকে। তারপর কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি। অবশেষে তীরে উঠলাম আমরা। মাটিতে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলাম হাপরের মতো।