ব্যস, প্রস্তুতি শেষ। এবার নামতে হবে। কিন্তু তবু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। ভয়ানক একটা কাজ করতে চলেছি। সফল না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই ভাগ। একটু মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
লিওর দিকে তাকালাম। আমার লিও। পাঁচ বছরের ছোট্টটি, যখন আমার কাছে এসেছিলো। এখন যৌবনোত্তীর্ণ প্রায়। দীর্ঘ সময়ে কখনও আলাদা হইনি আমরা। আজ যদি মৃত্যু আসে মরণের ওপারে গিয়েও এক সাথেই থাকতে চাই।
ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নির্বাক। তারপর নিচু, প্রায় ফিসফিস করে বললো, এসো।
পাশাপাশি দুটো বরফের খুঁটি ধরে নামতে শুরু করলাম। প্রথম কিছুক্ষণ মোটেই কঠিন মনে হল না কাজটাকে। দিব্যি খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরে পা বাধিয়ে নেমে যাচ্ছি দুজন। যদিও জানি, কোনোভাবে একবার হাত ফস্কালে যাত্রা করতে হবে মহাপ্রস্থানের পথে। তবে আমরাও কম নই। যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং বাওয়া-ছাওয়ার কাজে দক্ষ। তাছাড়া এধরনের পরিবেশ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।
প্রায় শখানেক ফুট নেমে থামলাম আমরা। খাদের গায়ে বেরিয়ে থাকা বিরাট একটা পাথরের চাইয়ে পা ঠেকিয়ে সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম নিচের দিকে। যা দেখলাম, সত্যি কথা বলতে কি, ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। একশো কি সোয়াশো ফুট নিচে খাদের গা তীক্ষ্ণ্ণ একটা বাঁক নিয়ে ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে মাঝখানের দিকে। ওটার জন্যে যাদের তল দেখতে পাচ্ছি না।
আবার নামতে শুরু করলাম। এবার আর আগের মতো সহজ মনে হচ্ছে না। কারণ প্রথমত, সামান্য হলেও ক্লান্ত হয়েছি, দ্বিতীয়ত, খাদের গায়ে উঁচু হয়ে থাকা পাথরের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। পায়ের নিচে কোনো অবলম্বন পাচ্ছি না। একেকবার মুহূর্তের জন্যে হাত ফস্কে যাচ্ছে, সড়সড় করে নেমে যাচ্ছি কয়েক ফুট; আঁতকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরছি বরফের খুঁটি বা ভাগ্যক্রমে পায়ের নিচে পেয়ে যাচ্ছি কোনো পাথর। কোমরে বাধা দড়ি খুব সাহায্য করছে। পাথর বা বরফের খাজে ওটার আলগা মাথা বাঁধিয়ে নামছি। অন্য একটা পাথরে পৌঁছে টেনেটুনে ছাড়িয়ে নিচ্ছি মাথাটা, তারপর আবার আরেকটা খাঁজে বাধিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছি।
অবশেষে পৌঁছুলাম বাকটার কাছে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই শো ফুট নেমে আসতে পেরেছি। ধারণা করছি আর শ দেড়েক ফুট নামতে পারলেই তলে পৌঁছে যাবো। কিন্তু সত্যি কি দেড়শো ফুট, না আরও বেশি? কি করে জানা যায়?
দেখতে হবে, বললো লিও।
বুঝলাম, কিন্তু কি করে? একটাই মাত্র উপায় আছে, বিপজ্জনক ঢালু কিনারে গিয়ে উঁকি দেওয়া। একই সাথে ব্যাপারটা অনুধাবন করলাম দুজন। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম আমি।
না, বাধা দিলো লিও, আমার বয়েস কম, শক্তিও তোমার চেয়ে বেশি। আমিই যাবো। এসো, আমাকে সাহায্য করো। কোমরের দড়িটা শক্ত করে একটা পাথরের কোনার সাথে বাঁধলো ও। তারপর বললো, এবার ধরো আমার গোড়ালি।
ব্যাপারটা পাগলামি মনে হলো আমার কাছে। কিন্তু উপায়ও নেই এছাড়া। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ছোট্ট একটা খুঁজে পা আটকে বসলাম। তারপর লিওর গোড়ালি দুটো ধরে ধীরে ধীরে শরীর ঝুঁকিয়ে দিলাম। হাত প্রসারিত করে দিলাম যতদূর যায়। বুকে ভর দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেল লিও। সামনের দিকে মুখ। একটু পরে ওর শরীরের অর্ধেকটা চলে গেল বাঁকের কিনারার আড়ালে।
তারপর হঠাৎ, দড়ি ছুটে গেল বলে না লিওর হাত ফস্কে গেল বলে জানি না, ওর সম্পূর্ণ শরীরের ওজন অনুভব করলাম আমার হাতে। হ্যাচকা এক টানে আমার হাত ছুটে গেল ওর গোড়ালি থেকে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম আমি। গলা চিরে তীক্ষ্ণ্ণ আর্তনাদের মত বেরিয়ে এলো একটা শব্দ: লিও!
লিও-ও-ও! আবার চিৎকার করলাম আমি। পরমুহূর্তে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ ভেসে এলো আমার কানে-এসো। (পরে জেনেছিলাম, আসলে লিও বলতে চেয়েছিল, এসো না।)।
এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। তারপর আর কোনো ভাবনা চিন্তার ধার ধেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম ঘষটে ঘষটে। দুসেকেণ্ডের মাথায় বাকের কিনারে পৌঁছুলাম। তিনের মাথায় টপকে ওপাশে।
অপ্রশস্ত একটা বরফের ঢল নেমে গেছে বাঁকের কিনার থেকে। খুব খাড়া নয়। লম্বায় ফুট পনেরো হবে। ক্রমশ সরু হতে হতে সংকীর্ণ, খুব বেশি হলে মানুষের হাতের সমান মোটা একটা শৈল-তাকে গিয়ে শেষ হয়েছে ঢালটা। যে গতিতে কিনারে এসেছি সেই একই গতিতে পিছলে নেমে যেতে লাগলাম। নিজের অজান্তেই হাত দুটো ছড়িয়ে গেল দুপাশে। মুহূর্ত-পরে পা ঠেকলো শৈল-তাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, এমন সময় ছড়িয়ে থাকা দুহাতের নিচে অনুভব করলাম কর্কশ কিছু একটা সম্ভবত বরফ, পাথরও হতে পারে। খপ করে খামচে ধরলাম সেটা। কোনোমতে রোধ করতে পারলাম পতনটা।
তারপর দেখতে পেলাম সব। আমার শিরা উপশিরার ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে গেল যেন! চামড়ার দড়ির প্রান্তটা আটকে গেছে শৈল-তাকের একটা খাঁজে। চার পাঁচ ফুট নিচে শূন্যে ঝুলছে লিও। ধীর অলস ভঙ্গিতে পাক খাচ্ছে ওর শরীর। নিচে হাঁ করে আছে অন্ধকার গহুর। কত নিচে যে এর তল বুঝতে পারলাম না। শুধু দেখলাম অন্ধকার যেখানে শেষ হয়েছে তারও বহু নিচে সাদা কি যেন। বরফই হবে হয়তো। কিন্তু হায়! কিছুই করার নেই আমার। যদি এক চুল নড়ি বা হাত আলগা করি ঐ গহ্বরে উল্টে পড়বো আমি নিজে। অন্যদিকে কোনোক্রমে যদি চামড়ার রশিটা খাঁজ থেকে ছুটে যায় পড়ে যাবে লিও। আমি এখন কি করবো? ওহ্, ঈশ্বর! বলো বলো, আফ্রিকি করবো?