আমাকে দেখে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন মিস্টার হলি। বুঝলাম, তাকে না জানিয়েই ডাকা হয়েছে আমাকে। তবে শিগগিরই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল আমার। চিকিৎসার শুরুতেই তাঁর শারীরিক কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারলাম বলেই সম্ভব হলো সেটা। পরে বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। দুনিয়ার নানা দেশে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন টুকরো টুকরোভাবে। এলোমেলো ভাবে দুটো অদ্ভুত অভিযানের কথা-ও বললেন একদিন। ভালো বুঝতে পারলাম না তার মর্ম। এই দশদিনে বার দুয়েক তাঁকে প্রলাপ বকতে শুনেছি। সে সময় যে ভাষায় তিনি কথা বলছিলেন, যতদূর বুঝতে পেরেছি তা গ্রীক এবং আরবী। ইংরেজীতেও ছিলো দু’একটা শব্দ। সম্ভবত তার আরাধ্য কোনো দেবীর কথা বলছিলেন তিনি।
একদিন কাঠের তৈরি একটা বাক্স দেখালেন ভদ্রলোক (সেটাই এই চিঠির সঙ্গে পাঠাচ্ছি আপনার কাছে), এবং আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে বললেন, যেন তার মৃত্যুর পর ওটা পাঠিয়ে দিই আপনার কাছে। একটা পাণ্ডুলিপিও দিলেন। বললেন বাক্সের সঙ্গে ওটাও পাঠাতে হবে আপনার কাছে। পাণ্ডুলিপিটার শেষ পৃষ্ঠাগুলো পোড়া। কৌতূহলী চোখে আমি তাকিয়ে ছিলাম পোড়া পৃষ্ঠাগুলোর দিকে। দেখে তিনি বললেন (হুবহু তার কথাগুলোই তুলে দিচ্ছি এখানে)–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর কিছু করার নেই এখন, যে ভাবে আছে ওভাবেই পাঠাতে হবে। দেখতেই পাচ্ছো, আমি ওটা নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম, আগুনে রিটার্ন অভ শী ফেলেও দিয়েছিলাম, তখনই এলো নির্দেশ—হ্যাঁ, পরিষ্কার নির্ভুল নির্দেশ-ছে মেরে তুলে নিয়ে বাঁচিয়েছিলাম আগুনের হাত থেকে।
এই নির্দেশ বলতে কি বুঝিয়েছিলেন মিস্টার হলি আমি জানি না। এ সম্পর্কে আর কিছু তিনি বলেননি।
যা হোক, নাটকের শেষ দৃশ্যে চলে আসি। একদিন রাতে, প্রায় এগারোটার সময়, আমি গেছি মিস্টার হলির বাসায়। তখন ওঁর শেষ অবস্থা। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা হলো তদারককারিণীর সাথে। হন্তদন্ত অবস্থা তার তখন। মিস্টার হলি মারা গেছেন কি না জানতে চাইলাম। সে জবাব দিলো, না, তবে উনি চলে গেছেন-যে অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থায়ই খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাড়ির ঠিক বাইরে যে ফার বন আছে সেখানে শেষ বারের মতো দেখেছে তাকে মহিলার নাতি। ছেলেটা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কারণ ওর মনে হচ্ছিলো, ভূত দেখেছেন মিস্টার হলি।
উজ্জ্বল চাঁদের আলো ছিলো সে রাতে। সদ্য পড়া তুষারে প্রতিফলিত হয়ে জ্যোৎস্না আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। আমি বেরিয়ে পড়লাম তাকে খোঁজার জন্যে। একটু পরেই তুষারের ওপর পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। ছাপ অনুসরণ করে গেলাম বাড়ির পেছনে, সেখান থেকে পাহাড়ের ভাল বেয়ে উঠে গেলাম চূড়ার দিকে।
পাহাড়টার চূড়ায় একটা প্রাচীন পাথরের স্তম্ভ আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা তার নাম দিয়েছে শয়তানের আংটি। কে কখন ওটা স্থাপন করেছিলো কেউ বলতে পারে না। অনেক বারই আমি দেখছি ওটা। কিছুদিন আগে এক প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতির সভায় ওটার উদ্ভব এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনাও শুনেছি। সেই। সভায় খেপাটে ধরনের এক ভদ্রলোক একটা প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তাতে তিনি নানা। যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, স্তম্ভটা মিসরীয় দেবী আইসিসের। প্রতিনিধিত্ব করে, এবং ঐ জায়গাটা এককালে আইসিসের পূজারীদের তীর্থস্থান ছিলো। কিন্তু অন্য আলোচকরা অভিমতটাকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেন। তারা বলেন, আইসিস ব্রিটেনে এসেছিলো এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। অবশ্য আমার ধারণা, রোমান বা ফিনিসীয়রাও এনে থাকতে পারে স্তম্ভটা। কারণ, ওরাও আইসিসের পূজা করতো। তবে এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান এত সামান্য যে এ-নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।
আমার মনে পড়লো, আগের দিন মিস্টার হলি জিজ্ঞেস করেছিলেন পাথরটার কথা। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এখনও ওটা অক্ষত আছে কিনা। তিনি আরও বলেছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে কথাটা আমার মনে দাগ কেটেছিলো, তিনি ওখানে গিয়ে মরতে চান। আমি বলেছিলাম, অতদূর হাঁটার ক্ষমতা সম্ভবত আর কখনও তিনি ফিরে পাবেন না। শুনে মৃদু হেসেছিলেন বৃদ্ধ।
যা হোক, যথাসম্ভব দ্রুত ছুটে পৌঁছুলাম শয়তানের আংটির কাছে। এবং হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তা-ই—স্তম্ভের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, খালি পা, খালি মাথা, পরনে রাতের পোশাক। তুষারের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার হলি। কেমন একটা সম্মোহিত ভঙ্গি। মন্ত্রোচ্চারণের মতো বিড় বিড় করে কিছু বলছেন। সম্ভবত আরবীতে। ডান হাতে উঁচু করে ধরা একটা আংটা লাগানো রত্ন খচিত দণ্ড (মিস্টার হলির ইচ্ছানুযায়ী ওটাও পাঠাচ্ছি আপনার কাছে)। রত্নগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। রাতের গভীর নিস্তব্ধতার ভেতর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ওটার সোনার ঘণ্টার অতি মৃদু টুংটাং শব্দ।
জীবনে আমি কোনো অতিলৌকিক ব্যাপারস্যাপার বা কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ঐ মুহূর্তে সেই আমারও মনে হলো আরও কেউ আছে ওখানে। আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্ত অনুভব করছি, অশরীরী কেউ। তারপর হঠাৎই অবয়ব নিতে শুরু করলো অদৃশ্য জিনিসটা। চমকে উঠলাম আমি। সত্যিই কিছু দেখেছিলাম, না চাঁদনী রাতে অমন এক পরিবেশে সম্মোহিত, উদ্ভ্রান্ত মিস্টার হলিকে দেখে নিছক মনে হয়েছিলো কিছু দেখেছি, জানি না। দেখলাম, প্রথমে অস্পষ্ট ছায়ার মতো কিছু একটা বেরিয়ে এলো স্তম্ভের চূড়া থেকে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে হতে জ্যোতির্ময় এক নারীর চেহারা নিলো। তার কপালে জ্বলে উঠলো উজ্জ্বল তারার মতো নীল একটা আলো