ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস নিলাম। কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খেলো আমার শরীর। পর মুহূর্তে চোখ মেলে দেখলাম ছিটকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, এক পাশে লিও অন্য পাশে রাইফেলটা।
ধীরে ধীরে তুষার মোড়া শক্ত মাটির ওপর বসলাম আমি। হাপরের মতো ওঠা নামা করছে বুক। নাক মুখ দিয়ে সমানে টেনে নিচ্ছি মুক্ত বাতাস।
লিও-ও উঠলো। রাইফেলটা কুড়িয়ে এনে বসলো আমার পাশে।
কতক্ষণ ছিলাম ওর নিচে? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
জানি না। মনে হয় বিশ মিনিটের কাছাকাছি।
বিশ মিনিট! মনে হচ্ছিলো বিশ শতাব্দী। কি করে বের করলে আমাকে?
শক্ত তুষারের ওপর ইয়াকের চামড়া বিছিয়ে শুয়ে হাত দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় পড়েছিলে তা তো দেখেছিলাম। খুব বেশি দূরে নয়। একেবারে নিচে পৌঁছে তোমার আঙুলগুলো দেখলাম। তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাটটা এগিয়ে দিলাম। ভাগজিলো ওটা ধরার মতো শক্তি তখনও ছিলো তোমার।
ধন্যবাদ, বুড়ো ছোকরা। আর কিছু আমি বলতে পারলাম না।
আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছো কেন? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো লিও। তুমি কি ভেবেছিলে বাকি পথটুকু আমি একাই যাবো? দম নেয়া হয়েছে? তাহলে ওঠো, দেরি করে লাভ নেই। বেশ কিছুক্ষণ বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে নিয়েছে, এবার একটু ব্যায়াম দরকার তোমার। জানো, আমার রাইফেলটা ভেঙে গেছে, তোমারটা তুষারের নিচে। ভালোই হয়েছে, কি বলো? কার্তুজগুলোর ভার আর বইতে হবে না। শুকনো হাসি ওর মুখে।
আবার আমরা রওনা হলাম। সামনে যাওয়া অর্থহীন। সুতরাং সেই আগের পাথরটার কাছেই আবার ফিরে এলাম। আমাদের নিজেদের এবং হতভাগ্য ইয়াকটার পায়ের ছাপ চোখে পড়লো। এখনও তেমনি আছে। আগের মতোই নির্দয় নিরাবেগ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে থাম দুটো-একটা খাদের এপাশে, অন্যটা ওপাশে। খাদটাও আগের মতোই খাড়া নেমে গেছে পাতালের দিকে। অগম্য।
ওদিকে সেই হিম-স্তরের কাছে চলো, বললো লিও।
নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম আমি ওর পেছন পেছন। ওখানে পৌঁছে সময় নষ্ট করলো না লিও। ঝুঁকে পরীক্ষা করলো হিমশিরার গোড়ার দিকটার অবস্থা। আমিও উঁকি দিলাম। আগেরবার যা দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পেলাম না। শ-চারেক ফুট গভীর খাদ। তার কিনার দিয়ে নেমে গেছে সরু, মোটা নানা ধরনের বরফের থাম বা শিকড়। একটা জলপ্রপাত আচমকা জমে বরফ হয়ে গেলে যেমন দেখতে হবে ঠিক তেমন। শিকড়গুলোর কোনোটা সরু হতে হতে তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাই জানতে চাইছি আমরা। কিন্তু বোঝা গেল না। নিশ্চিত যদি জানতাম তল পর্যন্ত পৌঁছেছে কোনোটা তাহলে সেটা বেয়ে নামার চেষ্টা করা যেতো। হতাশা, কালো হতাশা ছাড়া আর কিছু দেখছি না চোখে।
কি করবো আমরা? অবশেষে জিজ্ঞেস করলাম আমি। সামনে মৃত্যু, পেছনে মৃত্যু-পাহাড় পেরিয়ে ফিরে যাবো সে উপায় নেই, খাবার নেই এক বিন্দু। শিকার করে খাবার যোগাড় করবো তারও উপায় নেই। বন্দুক একটা হারিয়েছি, অন্যটা অকেজো। এখানে বসে থেকে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। একমাত্র অলৌকিক কোনো ঘটনাই আমাদের বাঁচাতে পারে।
অলৌকিক ঘটনা! জবাব দিলো লিও। আর কি ঘটবে বলো? ছোট পাহাড়টায় উঠেছিলাম কেন? ওটায় উঠেছিলাম বলেই তো বেঁচে গেছি হিমবাহের হাত থেকে; এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলবে না? তুষারের নিচ থেকে তোমার জ্যান্ত ফিরে আসা? আমার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসা, এবং তুষারের নিচে গিয়ে তোমাকে বের করে আনা? আমি মনে করি অদৃশ্য কোনো শক্তি এতদিন আমাদের সাহায্য করেছে। আগামীতেও করবে না কেন? তুমি কি মনে করো, এই শক্তির সহায়তা না পেলে এতদিন আমরা বেঁচে থাকতাম?
থামলো ও, তারপর যোগ করলো, তোমাকে বলছি, হোরেস, সঙ্গে খাবার, বন্দুক, ইয়াক, আরও যা যা দরকার সব থাকলেও আমি ফিরে যেতাম না ফিরে গেলে কাপুরুষ প্রমাণিত হয়ে যাবো না? তখন কি ও ওর যোগ্য মনে করবে আমাকে? না, হোরেস, এগিয়ে আমি যাবোই।
কিন্তু কি করে?
ঐ পথ ধরে। খাদের পাড় থেকে স্কুলে পড়া বরফের শিকড়ের দিকে ইশারা করলো লিও!
ও তো মৃত্যুর পথ!
হোক। মৃত্যু এলে আসবে। এখানে বসে থাকলেও তো মরবো, তার চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মরি। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এবার তোমার পালা।
আমিও ঠিক করে ফেলেছি। আমরা এক সাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, লিও, শেষ-ও করবো এক সাথে। হয়তো আয়শা জানে আমাদের এখনকার অবস্থা। আমাদের পরীক্ষা করছে, সময় হলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। শুকনো একটু হাসলাম আমি। যদি-না চলল, খামোকা সময় নষ্ট করছি।
.
নামার জন্যে সামান্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হলো। একটা চামড়ার কম্বল আর ইয়াকের চামড়াটা সরু ফালি করে কেটে গিট দিয়ে দড়ি মতো বানালাম। কোমরের কাছে বেঁধে নিলাম এই দড়ি। একটা প্রান্ত খোলা রইলো। এতে নামতে সুবিধা হবে।
তারপর আরেকটা কম্বল টুকরো টুকরো করে কেটে আমাদের হাঁটু এবং পাগুলো ঢেকে নিলাম। শক্ত বরফ বা পাথরের কোনা লেগে ছড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। চামড়ার দস্তানাগুলো পরে নিলাম হাতে। এগুলো হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাকি জিনিস-পত্র সব এক সাথে করে বেঁধে ফেলে দিলাম খাদের ভেতর। আশা করছি নিচে নেমে-যদি শেষ পর্যন্ত নামতে পারি-ওগুলো ফিরে পাবো।