মনটা সায় দিতে চাইছে না। এত দিনের সাথী। মরে গেছে বলেই আজ ওকে এভাবে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর হাতিয়ার বানাবো? কিন্তু এছাড়া উপায়-ই বা কি? ওর চামড়া না পেলে তো আমরাও মরবো। ধীরে ধীরে উঠে হাত লাগালাম লিওর সাথে। মনে মনে ক্ষমা চাইলাম জন্তুটার আত্মার কাছে। আমরা এখানে নিয়ে এসেছিলাম বলেই তো এমন অপঘাতে মরতে হলো বেচারাকে।
যা হোক, মনে মনে যা-ই ভাবি না কেন শেষ পর্যন্ত ওর মাংসও খেতে হলো। কাঁচা। খানিকটা তুষার মেখে চোখ বুজে খেয়ে ফেললাম। প্রাণ বাঁচাতে হবে, সে জন্যে শক্তি দরকার। না খেলে শক্তি আসবে কোত্থেকে? কাঁচা মাংস খাওয়ার সময় জংলী জংলী একটা অনুভূতি হলো মনে। কিন্তু এছাড়া কি-ইবা করার ছিলো। আমাদের?
.
০৫.
অবশেষে দিন শেষ হলো। এখনও আমরা নামার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। সন্ধ্যায় আরও কয়েক টুকরো ইয়াকের মাংস খেয়ে গুটিসুটি হয়ে আশ্রয় নিলাম চামড়ার নিচে। ভাগ্য ভালো, আমাদের সব পোশাক-আশাক গায়েই ছিলো। না হলে তাবুটার মতো অবস্থা হতো ওগুলোর-ও। সেক্ষেত্রে আজ রাতে ঠাণ্ডায় জমে মরা কেউ ঠেকাতে পারতো না।
হোরেস, ভোরে লিও বললো, আর হাত-পা কোলে করে বসে থাকতে রাজি নই আমি। মরতে যদি হয়-ই, চলতে চলতে মরবো; তবে আমার মনে হয় না আমরা মরবো।
বেশ, তাহলে চলো রওনা হই। এখনও যদি তুষার আমাদের ভার সইতে না পারে কোনো দিনই পারবে না।
ইয়াকের চামড়া আর কম্বলগুলো ভাঁজ করে বেঁধে পিঠে তুলে নিলাম। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ইয়াকের মাংসও নিলাম খানিকটা। তারপর শুরু করলাম নামতে।
.
হিমধসের সঙ্গে আসা ছোট বড় নানা আকারের পাথর প্রচুর পরিমাণে জমে আছে ছোট্ট পাহাড়টার গোড়ায়। ফলে ওঠার সময় যে জায়গাগুলো প্রায় খাড়া দেখেছিলাম সেগুলো এখন সহনীয় ঢলের রূপ নিয়েছে। নামতে অসুবিধা হলো না। রাতের ঠাণ্ডায় গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ভালো মতোই জমেছে। পা পিছলে যাচ্ছে। বা ভর দিতে সমস্যা হচ্ছে না।
প্রায় নেমে এসেছি। এপর্যন্ত ভালোই চলেছে সব। আর বিশ পা নামলেই পাদদেশে পৌঁছে যাবো। এমন সময় আলগা ধুলো আর গুঁড়ো তুষারের একটা স্কুপের মুখোমুখি হলাম। এটা পার হতেই হবে। পুরো পাহাড়টাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে চওড়া স্তূপটা। লিও দিব্যি পার হয়ে গেল। আমি ওর গজ দুয়েক ডান দিয়ে নামছি, দু-পা যেতেই আচমকা অনুভব করলাম পায়ের নিচে শক্ত স্তরটা ঝুর ঝুর করে ভেঙে গেল। পরমুহূর্তে কোমর সমান ধুলো আর তুষারের ভেতর আবিষ্কার করলাম নিজেকে। ডুবে যাচ্ছি। কয়েক সেকেণ্ড পর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেলাম আমি তুষারের নিচে।
আমার সে মুহূর্তের অনুভূতি কল্পনা করা সম্ভব নয়, যার অভিজ্ঞতা আছে সে-ই কেবল উপলব্ধি করতে পারবে। ক্রমশ নিচে, আরও নিচে চলে যাচ্ছি। অবশেষে, মনে হলো একটা পাথরের কাছে পৌঁছুলাম। আমার নিম্নাভিমুখী গতি রুদ্ধ হলো। তারপর অনুভব করলাম, আমি নিচে নেমে আসার সময় উপরে যে শূন্য স্থান তৈরি হয়েছিলো তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে চেপে আসা তুষারে। সেই সঙ্গে নেমে আসছে অন্ধকার। একটু পরে নিচ্ছিদ্র আঁধার গ্রাস করলো আমাকে। কেমন একটা শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। যেন আমার গলা চেপে ধরেছে কেউ। চেতনা লুপ্ত হয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। তাড়াতাড়ি দুপাশে ছড়িয়ে থাকা হাত দুটো নরম তুষারের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে এলাম মাথার কাছে। তারপর মুখের উল্টো দিকের তুষারে আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকলাম। ছোট্ট একটা গর্ত মতো হলো আমার মুখের সামনে। কিছুক্ষণের ভেতর খুব ধীরে ধীরে পরিশ্রুত বাতাস এসে জমতে লাগলো গর্তে। পরিপূর্ণ ভাবে না হলেও অনেকক্ষণ পর পর একবার শ্বাস টেনে প্রাণটাকে টিকিয়ে রাখলাম আমি।
কয়েক বার এমন শ্বাস নেয়ার পর বুঝতে পারলাম, এভাবে চলবে না। বাতাসের পরিমাণ এত কম যে খুব বেশিক্ষণ এখানে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। তার ওপর আছে নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই অক্সাইড। আশা ছেড়ে দিলাম আমি। বুকের নিচে পাথরটায় হাত বাধিয়ে একবার চেষ্টা করলাম, ওপরে উঠে যাওয়ার। পারলাম না। অগত্যা মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে গেলাম মনে মনে। কিন্তু কি আশ্চর্য, মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ যেমন দেখে তেমন নিজের জীবনের অতীত স্মৃতি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো না। আমার মন চলে গেল আয়শার কাছে। স্পষ্ট দেখলাম সেই অনিষ্টসুন্দর মুখ। ওর পাশে এক পুরুষ। অন্ধকার এক পাহাড়ী খাদে পড়ে আছি আমি। কিনারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আমাকে দেখছে আয়শা। ওর পরনে সেই দীর্ঘ কালো আংরাখা। চোখ দুটোয় ভয়। ওকে অভিবাদন জানানোনার জন্যে আমি উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু সে তীক্ষ্ণ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো-কি সর্বনেশে কাণ্ড! তুমি বেঁচে আছো, আমার প্রভু লিও কোথায়? বলো, কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার প্রভুকে? বলো–না হলে মরবে!
জবাব দেয়ার জন্যে আবার উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। মিলিয়ে গেল আয়শার মুখ।
তারপর আবার আলো দেখলাম আমি। আরেকটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এবার লিওর!
হোরেস! হোরেস, শক্ত করে ধরে রাইফেলের বাঁটটা!
কিছু একটা ঠেকলো আমার ছড়িয়ে থাকা হাতে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম ওটা। সঙ্গে সঙ্গে টান অনুভব করলাম হাতে। কিন্তু এক চুল নড়লো না আমার শরীর। তারপর আচমকা বাঁচার আকাঙক্ষা জেগে উঠলো আমার মনে। সর্বশক্তিতে হাত-পা ছুঁড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম, অবশ্যই হাত দিয়ে যেটা আঁকড়ে ধরেছি সেটা না ছেড়ে। আবার টান অনুভব করলাম হাতে। আবার হাত পা ছুঁড়লাম। অকস্মাৎ প্রচণ্ড একটা ওজন নেমে গেল শরীর থেকে। শেয়াল যেমন তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে গর্তের ভেতর থেকে তেমনি তুষার ভ্রুপের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছি আমি।