ওহ! সে দৃশ্য ভোলার নয়। আমাদের দুমাইল কি তারও বেশি দূরে ঢালের ওপর নড়ে-চড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে, গড়িয়ে নেমে আসছে বিশাল সাদার একটা স্থূপ। প্রতি মুহূর্তে আকার বদলাচ্ছে যেন ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ। উপরে অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে উঠছে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ, তুষার কণা। জমাট বাঁধা ঝরনা যেন।
আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে আসতে চাইছে আমাদের। বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো রকমে লিওর দিকে চাইলাম। ও-ও একই রকম বিরত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড লাগলো বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে। তারপর সংবিৎ ফিরলো দুজনের। আবার তাকালাম সরীসৃপের মতো ধীর অথচ নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে আসা বরফপুঞ্জের দিকে।
নাম না জানা ভয়ঙ্কর কোনো জন্তুর মতো গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ওটা। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো খুব ধীর গতিতে নামছে। কিন্তু মাত্র চার মিনিটের ভেতর দুমাইল পথ অতিক্রম করতে দেখে বুঝলাম কি ভয়ানক গতি ওটার। আর কয়েক শো গজ মাত্র দূরে রয়েছে আমাদের এই দেড়শো ফুট উঁচু ছোট পাহাড়টা থেকে।
ইতিমধ্যে কখন যে আমাদের ভয় কেটে গেছে টের পাইনি। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি ভয়ঙ্করের রূপ। আসছে। ঘোট ঘোট নুড়ি, পাথর, বরফের চাঙড়, তুষার; উঠছে, পড়ছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে। এক মুহূর্ত বিরাম নেই।
আর মাত্র শখানেক গজ। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের পাহাড় চূড়া থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে ওটার সম্মুখভাগ। তারমানে প্রায় একশো ফুট পুরু হিমবাহটা। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে শব্দের তীব্রতা। একটানা প্রচণ্ড গর্জনের মতো। মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে।
আর পঞ্চাশ গজ। বুঝতে পারছি না, ঠিক কি ঘটবে, যখন ওটা আছড়ে পড়বে এই পাহাড়ের গায়ে। কল্পনাও করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনও হইনি যে। অমোঘ নিয়তির মতো এগিয়ে আসছে ওটা।
শুয়ে পড়ো, লিও! কোনো মতে কথাটা বলার সুযোগ পেলাম। পর মুহূর্তে প্রচণ্ড মেঘ গর্জনের মতো শব্দ করে আছড়ে পড়লো, হিমবাহ আমাদের পাহাড়ের ওপর। ঝঞা বিক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউ যেমন ফুলে ফেঁপে, বেঁকে-চুরে ভেঙে পড়ে পাহাড়ী উপকূলে তেমনি। গম-গম, গুরু গুরু আওয়াজ ছাপিয়ে উঠলো তীব্র বাতাসের হিস হিস শব্দ। ভয়ঙ্কর ঝাঁপটাতে গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার ছিটকে এসে লাগলো আমাদের গায়ে। প্রায় কবর দিয়ে ফেললো আমাদের। মনে হলো একরাশ জ্বলন্ত কয়লা যেন কেউ ঢেলে দিলো গায়ের ওপর। উপুড় হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছি আমরা। ভূমিকম্পের মতো কাঁপছে বুকের নিচে পাথুরে মাটি। ঘড় ঘড়, গোঁ গোঁ, গুডুম ডুম আওয়াজ সমানে চলছে। মনে হচ্ছে কোনোদিনই বুঝি শেষ হবে না এই শব্দের তাণ্ডব। বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে ভয়ানক। ছোট্ট তবুটাকে অনেক আগেই উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথায় জানি না। প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি, বসন্তের প্রথম বাতাস যেমন ঝরা পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় তেমনি আমাদেরও বুঝি উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে পেছনের অতল গিরি খাদে।
ওপর দিয়ে, পাশ দিয়ে, প্রায় শরীর ছুঁয়ে সমানে ছুটে যাচ্ছে পাথর আর বরফের চাঙড়। কিন্তু ঈশ্বরের কি করুণা, আমাদের গা স্পর্শ করলো না একটাও। বৃষ্টির মতো আমাদের গায়ে ঝরে পড়ছে নুড়ি আর বরফের কুচি। তাতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, তবে মরণ কষ্ট নয়। একটু একটু করে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি বরফ আর তুষারের নিচে। আর বেশিক্ষণ এভাবে চললে মৃত্যু অবধারিত।
অবশেষে থামলো তাণ্ডব। কতক্ষণ ধরে চলেছে জানি না। দশ মিনিট হতে পারে, দুঘণ্টাও হতে পারে। কোনো ধারণা নেই আমাদের। শুধু মনে আছে, শব্দের প্রচণ্ডতা তুঙ্গে উঠতে উঠতে এক সময় আচমকা কমতে শুরু করলো। তারপর এক সময় মিলিয়ে গেল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের সুতীব্র বেগও প্রশমিত হয়ে এলো। গায়ের ওপর থেকে তুষার আর ছোট ছোট নুড়ির স্থূপ সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা।
সামনে খাড়া পাহাড়ের গায়ে প্রায় দুমাইল লম্বা আধ মাইল চওড়া একটা জায়গা যেখানে একটু আগেও শত ফুট পুরু বরফের স্তর ছিলো, এখন সেখানে দাঁত বের করা কঙ্কালের মতো উলঙ্গ পাথর। আমাদের তাবুটা যেখানে ছিলো সেখানে এখন কিছু নেই। ইয়াকটা মরে পড়ে আছে এক পাশে। বেচারার মাথা উড়ে গেছে কোনো পাথর বা বরফের চাঙড়ের ঘায়ে। ধ্যাতলানো গলার কাছে রক্ত জমে আছে থকথকে হয়ে। পেছনের বিশাল গিরিখাতটার প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে হিমবাহ আর তার বয়ে আনা পাথর, নুড়ি, ধুলোয়। ব্যস এ-ই। এ ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই সেই ভয়ানক ঘটনার। এই মুহূর্তে কেউ যদি হাজির হয় সে টেরও পাবে না একটু আগে কি প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে এখানে। আর আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি, সহ্য করেছি এবং এখনও বেঁচে আছি।
বেঁচে তো আছি, কিন্তু কি অবস্থা আমাদের? আলগা তুষারে ডুবে যাওয়ার ভয়ে পাহাড় থেকে নামার সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া একটু পরপরই দু-একটা ছোট ছোট আলগা পাথরের চাঁই গড়িয়ে নেমে আসছে ওপর থেকে। ছোট হলেও একেকটার আয়তন ছোটখাটো মানুষের সমান। গায়ে লাগলে ইয়াকটার যে দশা হয়েছে আমাদেরও তা ছাড়া অন্য কি হবে না। কিন্তু না নেমেই বা কি করবো? এই চূড়ার ওপর কতক্ষণ না খেয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে থাকবো?
ইয়াকটার চামড়া ছাড়াই এসো, হঠাৎ বলে উঠলো লিও। এরকম হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে কিছু করা ভালো। তাছাড়া রাতে যদি এখানেই থাকতে হয়, চামড়াটা কাজে লাগবে।