যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ পাহাড়ের ঢাল। সমস্ত দিন নেমেও পাদদেশে পৌঁছুতে পারলাম না। সুতরাং বাধ্য হয়েই আরেকটা রাত তুষারের ভেতর কাটাতে হলো। ভাগ্য ভালো, কয়েক হাজার ফুট নেমে আসতে পেরেছি। সে কারণে ঠাণ্ডার মাত্রা একটু সহনীয়। এখানে ওখানে দু’একটা খানা খন্দকে সূর্যের তাপে তুষার গলা পানি দেখতে পেলাম। তৃষ্ণা মেটানো সমস্যা হলো না। ইয়াকটাও পেট ভরে নিলো প্রায় শুকনো পাহাড়ী শ্যাওলা দিয়ে।
ভোর হলো। অবশিষ্ট খাবারের খানিকটা খেয়ে নিয়ে আবার রওনা হলাম আমরা। এখন আর নিচের সমভূমিটা দেখতে পাচ্ছি না। সামনে একটা শৈল প্রাচীর আমাদের দৃষ্টি আটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটা ফাটল মতো দেখা যাচ্ছে। ওই ফাটল গলে বেরিয়ে যাওয়ার আশায় সেদিকে এগোতে লাগলাম। দুপুর নাগাদ খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম প্রাচীরের। ফাটলটা অনেক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন। মনে হচ্ছে ওখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবো। হাঁটার গতি একটু বাড়ালাম আমরা। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো দরকার ছিলো না। মাত্র এক ঘণ্টা পরেই মুখোমুখি হলাম কঠিন সত্যটার।
শৈল প্রাচীরের ফাটল আর আমাদের মাঝখানে শুয়ে আছে খাড়া নেমে যাওয়া এক গিরিখাত। তিন চারশো ফুট গভীর। জল প্রবাহের শব্দ ভেসে আসছে নিচ থেকে। গিরিখাতের কিনারে পেীছে শেষ হয়ে গেছে পথ। তারপর গভীর খাদ। খাদের এপাশে ওপাশে উঁচু দুটো পাথরের স্তম্ভ। কিন্তু এমন জায়গায় এসে মানুষের তৈরি পথ শেষ হয় কি করে? হতাশ, বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছি আমরা।
হুঁ, বুঝতে পেরেছি, হঠাৎ লিও বললো, ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হয়েছে এই খাদ। তারপরই চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এপথে।
হতে পারে, জবাব দিলাম আমি, বা এমনও হতে পারে, এখানে কোনো কালে একটা সেতু ছিলো। তারপর কালের গ্রাসে পচে, ক্ষয়ে, খসে পড়েছে। যাহোক তাতে আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। অন্য একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে।
হ্যাঁ, এবং তাড়াতাড়ি। যদি না এখানেই চিরতরে আটকে থাকতে চাই।
সুতরাং ডান দিকে মোড় নিয়ে গিরিখাতের পাড় ধরে এগিয়ে চললাম আবার। প্রায় এক মাইল যাওয়ার পর ছোট একটা হিমশিরার কাছে পৌঁছুলাম। হিমায়িত জলপ্রপাতের মতো খাদের ভেতর ঝুলে আছে সে। কিন্তু খাদের তলায় পৌঁছেছে। কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি এখান থেকে খাদটা ক্রমশ আরও চওড়া ও আরও গভীর হতে শুরু করেছে।
সুতরাং আবার আগের জায়গায়ুরে এলাম। এবার পথটার বাঁ দিকে এগিয়ে চললাম গিরিখাতের পাডুধের। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম খাদের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড়। ঝকঝকে তুষার ছাওয়া ঢাল উঠে গেছে চূড়ার দিকে। গিরিখাতের অবস্থা সেই এক। নির্দয়, কূর, অগম্য।
এদিকে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে না পারলে বিপদ হবে। একটু থেমে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রায় আধমাইল দূরে খাদের কিনারে বড়সড় এক পাথরের চাঙড় দেখতে পাচ্ছি। ওটার ওপর উঠতে পারলে হয়তো পথের খোঁজ পাওয়া যাবে।
অনেক পরিশ্রমের পর যখন শ দেড়েক ফুট উঁচু চাঙড়টায় উঠলাম তখন সূর্য ডুবছে। অস্পষ্ট হলদেটে আলোতে দেখলাম, এপাশে খাদটা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানকার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি গভীর এবং চওড়া। গভীরতা এত বেশি যে উঁকি দিয়েও তল দেখতে পেলাম না। তবে জল প্রবাহের মৃদু কুলু কুলু শব্দ ঠিকই সৌছচ্ছে কানে। আচমকা প্রসারিত হয়ে খাদের প্রশস্ততা এখানে দাঁড়িয়েছে প্রায় আধমাই-এ।
এবার? কিছু ভাবতে পারছি না আমি। লিওর মুখেও চরম হতাশার ছাপ। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। এদিকে সূর্য ডুবে গেছে। দ্রুত আঁধার নেমে আসছে। এখন আর সেই পথের মুখে ফিরে যাওয়ার সময় নেই। পাথরের ওপরেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো। ইয়াকটাকে ভারমুক্ত করে তাবু খাটালাম। তারপর মঠ থেকে আনা খাবারের শেষটুকু খেয়ে নিলাম। কাল সকালে কোনো শিকার না পাওয়া গেলে অমাহারে থাকতে হবে। যা হোক, খাওয়ার পর সবগুলো ফারের পোশাক আর কম্বলে শরীর মুড়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম দুঃখ ভোলার আশায়।
.
ভোর হতে খুব একটা বাকি নেই, এমন সময় আচমকা ভয়ানক এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। অনেকগুলো কামান যেন একসঙ্গে গর্জে উঠেছে। তারপরেই হাজার হাজার অন্য রকম শব্দ।
হায় ঈশ্বর! ওকি? আঁতকে উঠলাম আমি।
তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না! দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নজরে পড়লো না। এদিকে আওয়াজ চলছে, অসংখ্য বন্দুকধারী একসাথে গুলি ছুঁড়লে যেমন হয় তেমন। ইয়াকটার ভেতর কেমন যেন অস্থিরতা, ছুটে পালানোর প্রবণতা, কিন্তু দীর্ঘদিনের সাথীদের ফেলে পালাতে পারছে না। একটু পরেই বদলে গেল শব্দ। এখন মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা যাঁতা যেন কেউ ঘোরাচ্ছে ঘড় ঘড় শব্দে। পিলে চমকে যেতে চায়।
ভোর বেলা অত্যন্ত দ্রুত ফর্সা হয়ে আসে চারদিক। আজও হলো। তারপর দেখলাম-দুচোখে রক্তহিম করা আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম, ধীর গতিতে নড়েচড়ে নেমে আসছে পাহাড়ের একটা পাশ। বিশাল এক হিমবাহ!