তৃতীয় দিন সকালে লিও বলেছিলো, ঘড়ির কাঁটার মতো নিশ্চিন্তে চলছে সব।
আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, শুরুটা যার ভালো তার শেষ সাধারণত ভালো হয় না। আমি ভুল বলিনি। সত্যিই এবার কষ্ট শুরু হলো। প্রথমত, পাহাড়গুলো খুব উঁচু। ওগুলোর নিচের দিকের ঢালে পৌঁছুতেই লেগে গেল দুদিন। সূর্যের তাপে তুষার নরম হয়ে গেছে, ফলে তার উপর দিয়ে হাঁটা অনেক বেশি আয়াসসাধ্য হয়ে উঠলো।
সপ্তম দিন সকালে এক সঙ্কীর্ণ শৈলপথের মুখে পৌঁছুলাম। চেহারা দেখে মনে হলো পাহাড়-শ্রেণীর অনেক গভীরে চলে গেছে ওটা। আশপাশে আর কোনো পথ না পেয়ে ঐ পথেই এগোলাম আমরা। কিছুদূর হাটার পর বুঝতে পারলাম এটা প্রাকৃতিক গিরিপথ নয়। কোনো কালে মানুষই তৈরি করেছিলো এ পথ। পাহাড়ের গায়ে অস্ত্রপাতির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। খাড়া উঠে গেছে পথটা। চওড়া সব জায়গায় মোটামুটি সমান। এটাও একটা প্রমাণ, পথটা প্রাকৃতিক নয়।
তিন দিন এগোলাম এই পথে। এগোলাম না বলে বলা ভালো উঠলাম। গিরিপথ বেয়ে যত এগোচ্ছি ততই এক পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছি আমরা। দিনে খুব একটা সমস্যা হলো না, কষ্ট যা হওয়ার হলো রাতে। এমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যে তাঁবুর ভেতরে, সমস্ত পোশাক-আশাক গায়ে দিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে, ইয়াকটার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসেও কাঁপতে হয় ঠকঠকিয়ে। সে ঠাণ্ডার স্বরূপ প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। বরফের মতো ঠাণ্ডা বললে কিছুই বলা হয় না।
অবশেষে দশম দিন বিকেলে শৈল পথের শেষ মাথায় পৌঁছুলাম। আর শখানেক গজ গেলেই গিরিপথের মুখ। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। ওখানেই তাবু খাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আসল কষ্ট শুরু হলো এবার। আগুন জ্বালানোর মতো কোনো জ্বালানী আর অবশিষ্ট নেই। পানি গরম করতে পারলাম না। তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে জমা তুষার চুষতে হলো। কিন্তু তাতে কি তৃষ্ণা মেটে? তীব্র ঠাণ্ডায় চোখ জ্বলছে। সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারলাম না দুজনের কেউ।
ভোর হলো। তারপর সূর্যোদয়। গুড়ি মেরে তাবুর বাইরে এলাম। গিরিপথের মুখ যেখানে তার শখানেক গজ ভেতরে আমাদের তাঁবু। হাত-পায়ের জড়তা কাটানোর জন্যে দৌড়ানোর ভঙ্গিতে মুখটার দিকে এগোলাম আমরা। আগে লিও, পেছনে আমি। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাঁক নিয়েছে শৈলপথ।
লিও-ই প্রথম মোড় ঘুরলো। পর মুহূর্তে বিস্মিত এক চিৎকার বেরোলো তার মুখ দিয়ে। এক সেকেণ্ড পর আমিও মোড় ঘুম। তারপর! সামনে আমাদের প্রত্যাশিত দেশ!
নিচে-অনেক নিচে, কমপক্ষে দশ হাজার ফুট হবে, বিছিয়ে আছে বিস্তৃত এক সমভূমি। যতদূর চোখ যায় কেবল সমান আর সমান। আকাশ যেখানে মাটির সাথে মিশেছে সেখানেও শেষ হয়নি এর বিস্তৃতি। তুষারের টুপি পরা বিরাট একটা নিঃসঙ্গ পাহাড়ই কেবল একটু ব্যতিক্রম এই দৃষ্টিক্লান্তিকর সমতলে। যদিও অনেক দূরে, তবু মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টার অবয়ব। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোয়া উঠছে গোল চূড়া থেকে। তার মানে ওটা একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এবং আরও দেখতে পাচ্ছি, জ্বালামুখের এপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক পাথরের স্তম্ভ। যার ওপর অংশের আকৃতি আংটার মতো।
হ্যাঁ, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওটা, আমরা যে অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলাম তার বাস্তব রূপ! দীর্ঘ যোলো বছর যার খোঁজে মধ্য এশিয়ার প্রতিটা অঞ্চল চষে ফেলেছি সেই জীবনের প্রতীক এখন আমাদের সামনে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আমাদের। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চেয়েও উঁচু ওটার আংটা। এতক্ষণে বুঝলাম, কি করে এই সুউচ্চ গিরিশ্রেণী পেরিয়ে সেই অলৌকিক আলো পৌঁছেছিলো মরুভূমির ওপাশে পাহাড়ের চূড়ায়।
আলোটার উৎস সম্পর্কেও নিশ্চিত হলাম এতক্ষণে। আংটার পেছনের ধোয়াই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে। আগ্নেয়গিরিটা যখন জীবন্ত, নিঃসন্দেহে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার বদলে আগুন বেরিয়ে আসে ওটার জ্বালামুখ দিয়ে। সেই আগুনের তীব্রতা কতখানি হতে পারে তা সে রাতে পাহাড় চূড়ায় বসে আমরা টের পেয়েছি।
এছাড়া সমভূমিতে আর যা দেখলাম তা হলো, প্রায় মাইল তিরিশেক দূরে বিশাল এক মাটির ঢিবির ওপর বিরাট একটা নগর। সমভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে প্রশস্ত এক নদী। তার তীরে গাছপালা ঘেরা এক জায়গায় নগরটা। চোখে ফিল্ড গ্লাস (আমাদের সামান্য যে দু-একটা যন্ত্রপাতি এখনও অবশিষ্ট আছে তার একটা এটা) লাগিয়ে দেখলাম, নগর ঘিরে ফসলের মাঠ। নগর আর মাঠের মাঝে। সীমানার কাজ করছে গাছগুলো। পরিশ্রমী কৃষকরা বীজ বোনার আগে চাষ দিয়েছে মাঠে। সেচের জন্যে খাল কেটে মাঠের ভেতর পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, আমাদের সামনে সেই আকাঙ্ক্ষিত দেশ। যোলো বছর কঠোর পরিশ্রমের পর যার খোঁজ পেয়েছি। মুহূর্তে আমরা ভুলে গেলাম সব পরিশ্রম, সব ক্লান্তির কথা। নতুন করে উদ্দীপনা জাগলো মনে। আর একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না। এক্ষুণি রওনা হতে হবে। ছুটে ফিরে এলাম তাবুর কাছে। কোনো রকমে জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে চাপিয়ে দিলাম ইয়াকটার পিঠে। তারপর বেরিয়ে পড়লাম আকাঙ্ক্ষিত দেশের পথে।
গিরিপথ শেষ, কিন্তু পথ এখনও শেষ হয়নি। পাহাড়ের এপাশেও ঢাল বেয়ে নেমে গেছে মানুষের তৈরি রাস্তাটা। ধীর অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে নামতে শুরু করলাম আমরা।