আচ্ছা! তারপর? কৌতূহল বৃদ্ধের কণ্ঠস্বরে।
সংক্ষেপে আমাদের কাহিনী শোনালাম তাকে। এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে শুনলো কোউ-এন। একটা কথাও বললো না। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কচ্ছপের মতো মাথা দুলিয়ে গেল শুধু।
এবার বলুন, সব শেষে যোগ করলাম আমি, কাহিনিটা অদ্ভুত না? নাকি আমাদের মিথ্যেবাদী ভাবছেন?
বিশ্ব-মঠের ভাইরা, মৃদু হেসে বৃদ্ধ জবাব দিলো, কেন তোমাদের মিথ্যাবাদী ভাববো, বলো? প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তোমরা খাঁটি মানুষ। যে কাহিনি ততমরা শোনালে তা সত্যি না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। একটা ব্যাপারেই শুধু আমি দ্বিমত পোষণ করি, তা হলো, তোমাদের ঐ সে-র। অমরত্ব—পৃথিবীতে কিছুই অমর নয়। তোমরা যাকে দেখেছিলে আর ক্যালিক্রেটিস বা আমেনার্তাস যাকে দেখেছিলো বা যার খোঁজে তোমরা চলেছে তারা এক নয়, হতে পারে না। এসবই সেই পুনর্জন্মের খেলা। যতদিন না আত্মা নির্বাণ লাভ করছে ততদিন ফিরে ফিরে পৃথিবীতে আসতে হবে। তোমাদের আয়শাও তেমনি এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে।
ভাই লিও, তুমি যদি তাকে পাও-ও, পাবে হারাবার জন্যে। অর্থাৎ আবার নতুন করে খোঁজ শুরু করতে হবে তোমাকে। হয়তো জনম জনম ধরে খুঁজে চলবে, কিন্তু পেয়েও পাবে না, হাতের মুঠোয় এসেও বেরিয়ে যাবে। আর, ভাই হলি, তোমার জন্যে, আমার জন্যেও, হারানো-ই সবচেয়ে বড় পাওয়া। তা-ই যদি হয়, তাহলে কেন ছুটবে মরীচিকার পেছনে? কেন নিজে তৃষ্ণার্ত থেকে পানি ঢেলে ভরবার চেষ্টা করবে ফুটো পাত্র? তাতে মাটিই কেবল ভিজবে, তোমার তৃষ্ণা তো মিটবে না?
তৃষ্ণা না মিটুক, মাটি উর্বরা হবে, আমি জবাব দিলাম। যেখানে পানি পড়ে সেখানেই প্রাণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর দুঃখ তো আনন্দেরই বীজ। ভাই খুবিলগান, আর বাধা দেবেন না আমাদের।
ঠিক আছে, দেবো না। তবে আমার একটা ধারণার কথা বলি, শোনার পর যদি মনে হয় যাবে, যেও, আমি কিছু বলবো না। লিওর দিকে তাকালো কোউ এন। তোমাদের গল্প শুনে বুঝতে পারছি আজ থেকে অনেক অনেক জন্ম আগে আইসিস নামের কোনো দেবীর চরণে তুমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলে, তাই না? তারপর এক নারী তোমাকে প্রলোভিত করে, তার সাথে অনেক দূরে পালিয়ে গিয়েছিলে। সেখানে কি হলো? প্রবঞ্চিত দেবী প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হত্যা করলো তোমাকে। সেই দেবী নিজে না হলেও, আমার বিশ্বাস তার কোনো প্রতিনিধি তার জ্ঞান আত্মস্থ করে তারই ইচ্ছায় তার হয়ে একাজ করে। কিন্তু পরে সেই প্রতিনিধি-সে নারী বা অশুভ আত্মা যা-ই হোক না কেন-মরতে অস্বীকার করে, কারণ ইতিমধ্যে সে ভালোবেসে ফেলেছে তোমাকে। সে জানে তুমি মৃত তবু সে অপেক্ষা করতে লাগলো, এই আশায়, পুনর্জন্ম নিয়ে আবার তুমি আসবে। তারপর তুমি যখন নতুন জন্ম নিলে সত্যিই তোমার সাথে দেখা হলো তার এবং মারা গেল সে। এখন পুনর্জন্ম নিয়েছে ও, ওকে নিতেই হবে। যে তোমাকে প্রলোভিত করেছিলো সে-ও পুনর্জন্ম নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এবারও তোমার সাথে তাদের দেখা হবে। তারপর সেই পুরনো ঘটনা নতুন বৃত্তে আবর্তিত হবে। তার মানে তোমার জন্যে আবার কষ্ট, দুঃখ, বেদনা। না, বন্ধুরা, যেও না-ঐ অভিশপ্ত গিরিশ্রেণী অতিক্রম কোরো না। এখানেই থাকো, আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করবো তোমাদের জন্যে।
না, জবাব দিলো লিও, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবো না।
বেশ, যাও তাহলে। তোমাদের প্রতিক্ষা করো। যখন এর ফসল তুলবে তখন আমার কথা স্মরণ কোরো। আমি জানি, বাসনার যে মদ তুমি পান করেছো তার প্রভাব বড় কঠিন।
.
০৪.
দুদিন পর সূর্যোদয় দেখলো আমরা মরুভূমির পথে হাঁটছি। পেছনে প্রায় মাইলখানেক দূরে পাহাড়ের ওপর অধিত্যকায় বসে আছে বিশাল প্রস্তর-বুদ্ধ। তার ওপাশে প্রাচীন মঠ। আকাশ ঝলমলে, পরিষ্কার। বুদ্ধমূর্তির পাশে আমাদের বন্ধু বৃদ্ধ খুবিলগান কোউ-এন-এর ঝুঁকে থাকা অবয়বটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। বিদায় জানানোর সময় হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিলো বৃদ্ধ। সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলো আমাদের। কিন্তু কিছু করার নেই, যে নিয়তি আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে তার অমোঘ নির্দেশ কি করে আমরা লংঘন করবো?
যতক্ষণ না ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ততক্ষণ একটু পরপরই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম বৃদ্ধকে। অবশেষে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে চোখ ফেরালাম।
.
পাহাড়-চূড়ায় সেই রহস্যময় আলো যখন আমাদের ওপর এসে পড়েছিলো তখন কম্পাস ছিলো আমার কাছে। আলোটা কোন্দিক থেকে এসেছিলো দেখে নিতে পেরেছিলাম। সেদিকেই চলেছি আমরা।
আবহাওয়া চমৎকার। সামনে দুস্তর মরু। সারাদিন হেঁটে গোটা দুয়েক বুনো গাধার পাল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়লো না। সন্ধ্যার একটু আগে একটা অ্যান্টেলোপ মারতে পারলাম। তারপর রাতের মতো যাত্রাবিরতি। যেটা নিয়ে পাহাড়-চূড়ায় উঠেছিলাম সেই ছোট্ট তাবুটা সঙ্গে আছে। ওটা খাটালাম। ইয়াকের পিঠে একটা বস্তায় কিছু শুকনো খড়কুটো এনেছি। আগুন জ্বাললাম তা দিয়ে। রাতে চা আর অ্যান্টেলোপের মাংস দিয়ে রাজসিক খাবার খেলাম। অ্যান্টেলোপটা মারতে পারায় আমাদের সাথে যে সামান্য শুকনো খাবার আছে তার ওপর একটু চাপ কমলো।
পরদিন সকালে প্রথমেই আমাদের অবস্থান যাচাই করে নিলাম। সবদিক বিবেচনা করে ধারণা হলো মরুভূমির চার ভাগের একভাগ অতিক্রম করতে পেরেছি। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় প্রমাণিত হলো, নিখুঁত ধারণা করেছিলাম। মরুভূমির ওপাশে যে বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী তার পাদদেশে পৌঁছে গেছি।