ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নাশতা তৈরি।
আমি সকাল সকাল রওনা হয়ে যেতে চাই, ব্যাখ্যা করলো লিও।
পাগল হয়েছো তুমি!? ও জায়গায় থাকবো কি করে আমরা?
জানি না, তবে আমি যাচ্ছি। আমাকে যেতেই হবে, হোরেস।
তার মানে আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু ইয়াকটার কি হবে?
যাবে আমাদের সঙ্গে। যেখানে আমরা উঠতে পারবো, সেখানে ও-ও পারবে।
সুতরাং তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইয়াকের পিঠে বোঝাই দিলাম আবার। রান্না করা কিছু ভেড়ার মাংস নিলাম সঙ্গে। তারপর রওনা। ইয়াকটা সঙ্গে থাকায় একটু ঘুর পথে উঠতে হলো। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।
চূড়ায় উঠে প্রথমেই এক জায়গায় ঝুরো ঝরো তুষার সরিয়ে একটা গর্ত করে তবু খাটালাম তার ওপর। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাঁবুর ভেতর নেমে পড়লাম আমরা ইয়াক আর তার পিঠের মালপত্রসহ। খাওয়া-দাওয়ার পর অপেক্ষা, শুরু হলো।
ওহ, কি ঠাণ্ডা! শূন্যের নিচে কয়েক ডিগ্রী হবে। আমাদের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ভাগ্য ভালো ইয়াকটাকে এনেছিলাম। ওর লোমশ শরীরের উত্তাপ না পেলে হয়তো মরেই যেতাম।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সেকেণ্ড, মিনিট, ঘণ্টা। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসের একটানা শো শো আওয়াজ কেবল কানে আসছে। ঝিমুনি লেগে এলো আমার। হঠাৎ শুনতে পেলাম লিওর কণ্ঠস্বর।
দেখ, হোরেস, ঐ যে ঐ তারার নিচে!
তাকাতেই দেখলাম দূরে আকাশের গায়ে সেই আভা, গতরাতে যেখানে দেখেছিলাম ঠিক সেখানে। কাল যা দেখতে পাইনি তা-ও দেখতে পেলাম আজ। আভার নিচে আমাদের প্রায় সোজাসুজি হালকা একটা আগুনের শিখা। তার সামনে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কালো কিছু একটা।
দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আগুন। সামনের কালো জিনিসটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এবং ওটা ,ওহ! গায়ের ভেতর শির শির করে উঠলো। আমার! জিনিসটা মাথা তুলে দাঁড়ানো একটা স্তম্ভের উপরিভাগ, তার ওপর বসানো রয়েছে একটা আংটা। হ্যাঁ, আর কিছু নয়, ওটা ক্রুক্স আনসাতা, মিসরীয়রা যাকে জীবনের প্রতীক বলে মনে করে!
প্রতীকটা মিলিয়ে গেল। আগুন ম্লান হয়ে এলো। তারপর আবার জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। আগের চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আংটাটা। আবার মিলিয়ে গেল। তৃতীয় বারের মতো লাফিয়ে উঠলো অগ্নিশিখা। এবার আরও উজ্জ্বল। তীব্রতম বিদ্যুৎচমকও সে উজ্জ্বলতার কাছে হার মানে। সারা আকাশ আলোকিত হয়ে উঠলো। আংটার ভেতর দিয়ে জাহাজের সার্চলাইটের মতো ঠিকরে বেরিয়ে এলো একটা আলোক স্তম্ভ। নিমেষে বিস্তীর্ণ মরুভূমি পেরিয়ে এসে আলোকিত করে তুললো আমাদের পাহাড় চূড়া। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার অন্ধকার চারদিক। দূরে সেই আগুন আর আলোও উধাও।
অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।
তোমার মনে আছে, হোরেস, অবশেষে নীরবতা ভাঙলো লিও, টলমলে পাথরটার ওপর দিয়ে যখন আমরা ফিরে আসছিলাম কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া আলোর রেখা মৃত্যুপুরী থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ দেখিয়েছিলো আমাদের? আমার ধারণা সেই আলোই আবার এসেছে, এবার জীবনপুরীর পথ দেখাবে। সাময়িকভাবে যে আয়শাকে আমরা হারিয়েছি তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।
হতে পারে, সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার।
নিঃশব্দে বসে রইলাম আমি আর লিও। ভোর হলো। বৃদ্ধ কোউ-এন-এর কথাই ঠিক। বাতাসের বেগ বেড়েছে। সেই সাথে একটু একটু তুষারও পড়ছে। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় লাগলো না আমাদের। তীব্র কনকনে বাতাস আর তুষারপাত উপেক্ষা করে নামতে শুরু করলাম। অপূর্ব এক তৃপ্তির অনুভূতিতে ছেয়ে আছে হৃদয়। আমরা যেন এ পৃথিবীর নই। এখানকার তুচ্ছ দুঃখ, বেদনা আমাদের মনে আর দাগ কাটছে না। অপার আনন্দের সন্ধান পেয়েছি যেন আমরা।
গুহার কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তীব্রতর হলো তুষার-ঝড়। কিন্তু না থেমে নেমে চললাম আমরা। কোন কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে পৌঁছুলাম মঠের দরজায়। সম্পূর্ণ নিরাপদে। বৃদ্ধ খুবিলগান আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সন্ন্যাসীরা। এমন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও আমরা মরিনি দেখে আশ্চর্য ওরা।
.
অবশেষে শীত বিদায় নিলো। একদিন সন্ধ্যায় বাতাস একটু উষ্ণ মনে হলো। পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। তা থেকে ঝরছে তুষার নয়, জল। একটানা তিন দিন বৃষ্টি হলো। চতুর্থ দিন ঢল নামলো পাহাড় বেয়ে। এক সপ্তাহের মাথায় সামনের উর্বর জমিটুকু সবুজ হয়ে উঠলো। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। কিন্তু কোথায় যাবে তোমরা? ম্লান মুখে, প্রশ্ন করলো বৃদ্ধ খুবিলগান। এখানে আর ভালো লাগছে না? আমাদের প্রতি কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছে? কেন আমাদের ছেড়ে যাবে?
আমরা পথিক, আমি জবাব দিলাম, পথের মাঝে পাহাড় দেখলে তা টপকাতেই হবে।
তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে চাইলো কোউ-এন। পাহাড়ের ওপারে কি খুঁজবে তোমরা? আমার কাছে সত্য গোপন কোরো না। বলো, অন্তত প্রার্থনা করতে পারবো তোমাদের জন্যে।
মাননীয় খুবিলগান, কিছুদিন আগে গ্রন্থ-কক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন আপনি…।
ও কথা মনে করিয়ে দিও না, ভাই, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললো। কেন আমাকে যন্ত্রণা দিতে চাইছো?
না, বন্ধু, আপনি ভুল ভাবছেন। আমরা যা বলতে চাইছি তা হলো, আপনার কাহিনি আর আমাদের কাহিনি এক। ঐ পূজারিণীর সান্নিধ্যে আমরাও এসেছিলাম।