দেখুন শিকারটা আসলে মুখ্য নয়, বললাম আমি, চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে। সেজন্যে একটু ঘুরে ফিরে আসতে চাই। সম্ভব হলে এই পাহাড়ের চূড়ায় একবার উঠবো। শরীরের জড়তা কাটবে। এর ভেতর যদি শিকার কিছু মেলে মন্দ কি? আমাদের ধর্মে তো প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ নয়।
বুঝলাম, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক, বললো কোউ-এন। যেকোনো মুহূর্তে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হতে পারে।
খারাপ আবহাওয়ায় আমরা অভ্যস্ত, খুব একটা অসুবিধা হবে না।
ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো বৃদ্ধ। তারপর বললো, ঠিক আছে, যাও। পাহাড়ের ঢালে একটু ওপরে একটা গুহা আছে। হঠাৎ যদি আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ে, ওখানে আশ্রয় নিও।
অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী এক সন্ন্যাসী গুহাটা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলো।
পরদিন ভোরে ইয়াকটার পিঠে (ইতিমধ্যে আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে, ওটা) কিছু খাবার, কাপড়-চোপড় আর একটা ছোট চামড়ার তাবু চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম মঠ থেকে। পথ প্রদর্শক সন্ন্যাসীর পেছন পেছন মঠের উত্তর পাশের ঢাল বেয়ে উঠে যেতে লাগলাম চূড়ার দিকে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুহার কাছে।
চমৎকার গুহাটা। শীতের দিনে শিকারে বেরিয়ে আশ্রয় নেয়ার আদর্শ স্থান। ঘাস পাতায় ভর্তি হয়ে আছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে জ্বালানীর অভাব হবে দিনের বাকি সময়টুকু আমরা গুহায় কাটিয়ে দিলাম। রাতে থাকবার জন্যে পরিষ্কার করলাম খানিকটা জায়গা। সেখানে তাঁবুটা খাড়া করলাম। তারপর ওটার সামনে বড় একটা আগুন জ্বেলে পাহাড়ের ঢালগুলো পরীক্ষা করতে বেরোলাম। সন্ন্যাসীকে বলে গেলাম, হরিণের পায়ের ছাপ খুঁজতে যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাছাই করলাম কোন্ ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠবে। ফিরতি পথে কিছুদূর আসতেই বুনো ভেড়ার একটা পাল নজরে পড়লো। একই সঙ্গে গুলি বেরোলো আমার আর লিওর বন্দুক থেকে। দুটো ভেড়া মরলো। আগামী দিন পনেরো আর খাবারের অভাব হবে না। তুষারের ওপর দিয়ে টানতে টানতে গুহার কাছে নিয়ে এলাম ভেড়া দুটোকে। চামড়া ছাড়িয়ে গুহার ভেতর রেখে দিলাম তুষার চাপা দিয়ে।
বহুদিন পর তাজা ভেড়ার মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। প্রাণী হত্যার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই হোক না কেন, সন্ন্যাসী বাবাজীও আমাদের মতোই তুপ্তির সাথে মাংস খেলো। এরপর আগুনের সামনে গুটিসুটি মেরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।
ভোর হলো। আবহাওয়া আগের মতোই শান্ত। আমাদের পথ প্রদর্শক বিদায় নিলো। ওকে বলে দিলাম, দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা মঠে ফিরবো। যতক্ষণ না ছোট্ট একটা চূড়ার আড়ালে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল ততক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি আর লিও। তারপর উঠতে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে।
কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। কোনো কোনো জায়গায় প্রায় খাড়া উঠে গেছে। পাহাড়ে ওঠার যত কৌশল জানা আছে সব প্রয়োগ করে উঠে চলেছি আমরা। অবশেষে দুপুরের সামান্য আগে পৌঁছুলাম চূড়ায়। অপূর্ব এক দৃশ্য ভেসে উঠলো আমাদের সামনে। নিচে বিস্তৃত মরুভূমি। তার ওপাশে বরফের টুপি পরা পাহাড়শ্রেণী। সামনে, ডানে, বাঁয়ে যেদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়।
আঠারো বছর আগে স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমন ঐ পাহাড়গুলো, বিড়বিড় করে উঠলো লিও। ঠিক তেমন। হুবহু এক।
আলো ছুটে এসেছিলো কোন্খান থেকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মনে হয় ওখান থেকে, উত্তর-পুব দিকে ইশারা করলো ও।
কিন্তু এখন তো কিছু দেখছি না।…চলো ফিরি, ভীষণ ঠাণ্ডা এখানে।
নামতে শুরু করলাম আমরা। গুহায় যখন পৌঁছুলাম তখন সূর্য ডুবছে।
পরের চারটে দিন একই ভাবে কাটলো। ভোরে বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে উঠে যাই চূড়ায়। লিওর স্বপ্নে দেখা আলোকস্তম্ভের খোঁজ করি। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসি গুহায়।
চতুর্থ দিন রাতে ভেতরে ঢুকে ঘুমানোর পরিবর্তে গুহার মুখে বসে রইলো লিও। বারকয়েক আমি ওকে ডাকলাম ভেতরে। ও এলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
মাঝরাতে লিওর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চমকে উঠে বসলাম।
হোরেস! চিৎকার করলো ও, দেখবে এসো!
লিওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে। পোশাক পরার ঝামেলা পোহাতে হলো না, কারণ আমরা ওগুলো পরেই ঘুমাই। উত্তর দিকে ইশারা করলো লিও। আমি তাকালাম। বাইরে কালো রাত। কিন্তু দূরে, বহু দূরে অস্পষ্ট এক ফালি আলো জ্বল জ্বল করছে আকাশের গায়ে। দেখে মনে হয় মাটিতে আগুন জ্বলছে, তার আভা।
কি মনে হচ্ছে? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো লিও।
বিশেষ কিছু না। অনেক কিছুই তো হতে পারে। চাঁদ-না, চাঁদ না, ভোর হচ্ছে-না, তা-ও না, ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। কিছু জ্বলছে। বাড়ি বা শ্মশান-চিতা। কিন্তু-কিন্তু এখানে ওসব আসবে কোত্থেকে? জানি না!
আমার মনে হয় ওটা প্রতিফলন। চূড়ায় থাকলে দেখতে পেতাম কি থেকে আসছে ওটা।
হ্যাঁ, কিন্তু আমরা চূড়ায় নেই, এই অন্ধকারে যাওয়াও সম্ভব নয়।
সেক্ষেত্রে, হোরেস, অন্তত একটা রাত আমাদের চূড়ায় কাটাতে হবে।
তারপর যদি তুষার ঝড় শুরু হয়ে যায়?
ঝুঁকিটা আমাদের নিতে হবে, তুমি না চাইলে আমি একাই নেবো। দেখ, মিলিয়ে গেছে আলোটা।
দেখলাম, সত্যিই তাই। ঠিক আছে, কাল এনিয়ে আলাপ করা যাবে। আপাতত প্রসঙ্গটার ইতি টেনে গুহায় ঢুকলাম আমি। কিন্তু লিও বসে রইলো বাইরে।