কেমন-কেমন দেখতে ছিলো? আগ্রহ লিওর কণ্ঠস্বরে।
কেমন দেখতে ছিলো? আহ…কি বলবো! দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেন ওর ভেতর পুঞ্জীভূত হয়েছিলো। তুষারের ওপর ভোর হতে দেখেছো? বসন্তের প্রথম ফুল? পাহাড়ের চূড়া ছাড়িয়ে আরও ওপরে সন্ধ্যাতারা? যদি দেখে থাকো তাহলে বুঝতে পারবে ওর সৌন্দর্য কেমন। ভাই, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, আমি বলতে পারবো না। ওহ! পাপ, আমার পাপ! আমি গড়িয়ে গড়িয়ে পেছনে চলে যাচ্ছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, তোমরা আমার গোপন লজ্জা দিনের আলোয় নিয়ে আসছে। না…না, আমি স্বীকার করবো, আমি স্বীকার করবো, তোমরা দেখ, আমি কি নীচ। তোমরা হয়তো তোমাদের মতোই পবিত্র ভাবছো আমাকে, কিন্তু আসলে আমি কি তা দেখ।
সেই মেয়েমানুষটা—জানি না সত্যিই সে মেয়েমানুষ কিনা, আমার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিলো, যে আগুন নেভে না, কিছুতেই নেভে না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে ফেলে। তারপর আরও জ্বলে আরও জ্বলে। করুণ ভাবে মাথা দোলাতে লাগলো কোউ-এন। তার শিং-এর চশমার নিচ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। ও-ও আমাকে ওর পূজা করিয়ে ছেড়েছে। প্রথমে আমার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বলেছি। আশা করছিলাম, ওর হৃদয়ে সত্যের আলো পৌঁছুবে। কিন্তু আমার কথা শেষ হতেই সে বললো–
তার মানে তোমার পথ ত্যাগের। বোকা! তোমার এই নির্বাণ হলো চমৎকার এক নিরর্থক ধারণা। যার কোনো ভিত্তি নেই। তারচেয়ে এসো তোমাকে মহান এক দেবী আর অনেক আনন্দদায়ক এক উপাসনার পথ দেখাই।
কি পথ? কোন্ দেবী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
প্রেম ও জীবনের পথ, জবাব দিলো সে, যার ভেতর দিয়ে উৎপত্তি সমগ্র পৃথিবীর। হে নির্বাণপিয়াসী সন্ন্যাসী, তোমারও জন্ম এই প্রেমের ভেতর দিয়ে। আর দেবী? সে হলো প্রকৃতি।
আবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় সেই দেবী। রাজকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো সে। সুডৌল সুউচ্চ বক্ষে হাত রেখে বললো, আমিই সে। হাঁটু গেড়ে বসো, আমাকে প্রণাম করো।
আমি তা-ই করলাম, ভাই হলি, ভাই লিও, আমি তা-ই করলাম! হাঁটু গেড়ে বসে তার পায়ে চুমু খেলাম। তারপরই সংবিৎ ফিরলো আমার। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। ছুটে পালিয়ে গেলাম সেখানে থেকে। আমার পালানো দেখে হেসে উঠলো সে। চিৎকার করে বললো: আমি তোমার সাথে সাথেই থাকবো, ও বুদ্ধের দাস। আমার রূপ বদলাতে পারে, কিন্তু আমি মরি না। যদি নির্বাণ লাভ করো, তখনও আমি তোমার সাথে থাকব। যে একবার আমার কাছে প্রণত হয় তাকে আমি কখনও ছেড়ে যাই না।
ব্যস, এখানেই শেষ, ভাই হলি ..সত্যিই ও আমাকে ছেড়ে যায়নি। তারপর যতবার পুনর্জন্ম নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছি, ওর স্মৃতি কুরে কুরে খেয়েছে আমাকে। জানি আগামী জন্মগুলোতেও এমনই চলবে। অনন্ত শান্তি আমি কখনোই পাবো না… শীর্ণ হাতদুটো দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো কোউ-এন।
হাস্যকর দৃশ্য। মহামান্য একজন খুবিলগান, যার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, বাচ্চাছেলের মতো কাঁদছে। কেন? স্বপ্নে দেখা এক সুন্দরীর স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। তাই। কিন্তু আমি বা লিও মোটেই হাসলাম না, বরং অদ্ভুত এক সহমর্মিতা অনুভব করলাম কোউ-এন-এর জন্যে। পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্ত্বনা দিলাম তাকে।
কিছুক্ষণ পর সামলে নিলো বৃদ্ধ। তারপর আরও কিছু তথ্য আদায় করার চেষ্টা করলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু লাভ হলো না খুব একটা। বিশেষ করে যে ব্যাপারটায় আমরা আগ্রহী সেই পূজারিণীয় প্রসঙ্গে নতুন প্রায় কিছুই বলতে পারলো না সে। পর দিনই সেনাদলের সঙ্গে চলে গিয়েছিলো পূজারিণী। ব্যস এটুকুই। তবে হ্যাঁ, সে সময়কার সুবিলগানকে একটা মন্তব্য করতে শুনেছিলো। কোউ-এন, তা হলো, কেন জানি না তার ধারণা হয়েছিলো, ঐ পূজারিণীই আসলে গ্রীক বাহিনীর সেনাপতি। তারই ইচ্ছায় বাহিনীটা মরুভূমি পেরিয়ে উত্তরে যাচ্ছিলো। সম্ভবত ওদিকে কোথাও নিজেকে দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো সে।
মরুভূমির ওপারে যে পাহাড়ী এলাকা সত্যিই সেখানে কোনো জনবসতি আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলাম কোউ-এনকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বৃদ্ধ বললো, তার ধারণা আছে। বর্তমানে বা পূর্ববর্তী কোনো জীবনে, ঠিক মনে নেই, সে শুনেছে, ওরা অগ্নি উপাসনা করে। আরও বললো, এক ভাই এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলো নির্জনে সাধনা করার জন্যে। সে নাকি ঐ পাহাড়গুলোর ওপাশে আকাশে বিশাল এক অগ্নি-স্তম্ভ দেখেছে। চোখের ভুল কিনা সে সম্পর্কে অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি সে।
আর কিছু না বলে ধীর পায়ে গ্রন্থ-কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধ খুবিলগান। পরের এক সপ্তাহ সে আর আমাদের সামনে আসেনি। এ প্রসঙ্গও আর কখনও তোলেনি আমাদের সামনে। আর আমরা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠবে এই পাহাড়ের চূড়ায়।
.
০৩.
সপ্তাহ খানেকের ভেতর সুযোগ এসে গেল।
এখন শীতের মাঝামাঝি। তুষার ঝড় থেমে গেছে। সন্ন্যাসীদের কাছে। শুনলাম, এসময় নাকি ওভিস পোলি এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ী হরিণ খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসে গোপন আস্তানা ছেড়ে। শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলাম আমরা। বললাম, কালই আমরা শিকারে বেরোবো।
প্রাণী হত্যার কথায় অত্যন্ত মর্মাহত হলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।