লোকটা বলেছিলো, ওরা খুব যুদ্ধপ্রিয় জাতি, যদিও ওদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। দেশ শাসন করে গ্রীক রাজা আলেকজাণ্ডারের বংশধর এক পরিবার। প্রধান শাসকের পদবী খান। কথাটা সত্যি হতেও পারে, কারণ আমাদের নথিপত্র বলছে, প্রায় দুহাজার বছর আগে আমাদের এ-অঞ্চল জয়ের জন্যে এক সেনা বাহিনী পাঠিয়েছিলো ঐ গ্রীক রাজা (অর্থাৎ আলেকজাণ্ডার)।
লোকটা আরও জানায় ওদের দেশের মানুষ অমর এক পূজারিণীর উপাসনা করে, যার নাম হেস বা হে, যুগ যুগ ধরে সে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। আরও দূরের এক পাহাড়ে সে থাকে। সব মানুষ তাকে ভয় করে, পূজা করে। ক্ষমতা থাকলেও রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে সে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। তার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও বলিদান করা হয়, কেউ যদি এই পূজারিণীর রোষানলে পড়ে তবে তার আর রক্ষা থাকে না, অবশ্যই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এই কারণে দেশের শাসকরাও তাকে ভয় করে।
এসব শুনে আমরা উপহাস করলাম লোকটাকে। বললাম, সে মিথ্যে বলছে। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, চিৎকার করে ঘোষণা করলো, আমাদের বুদ্ধ নাকি ওদের সেই পূজারিণীর মতো ক্ষমতাবান নয়। আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সে তার প্রমাণ দেবে।
কিছু খাবার দিয়ে আমরা ওকে মঠ থেকে বিদায় করে দিলাম। যখন ফিরে আসবো তখন টের পাবে কে সত্যি কথা বলে, বলতে বলতে চলে গেল লোকটা। পরে ওর কি হয়েছিলো সে-সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারিনি আমরা। আমাদের ধারণা, কোনো এক অশুভ শক্তি ওর ছদ্মবেশে আমাদের ভয় দেখাতে এসেছিলো।
.
পরদিন আমাদের সঙ্গে গ্রন্থ-কক্ষে যাওয়ার অনুরোধ করলাম খুবিলগান কোউ এনকে। কাহিনীটা পড়ে শুনিয়েজিজ্ঞেস করলাম, এ সম্পর্কে আর কিছু সে জানে কিনা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে। কোউ-এন-এর এই ভঙ্গিটা দেখলেই কচ্ছপের কথা মনে পড়ে যায় আমার।
সামান্য, বললো সে। খুব সামান্য। তার বেশির ভাগই ঐ গ্রীক রাজার সেনাবাহিনী সম্পর্কে।
যেটুকু জানে সেটুকুই বলতে অনুরোধ করলাম কোউ-এনকে। শান্তভাবে শুরু করলো বৃদ্ধ
তখনও পবিত্র পথের অনুসারীর সংখ্যা খুব বেশি হয়নি। এই মঠ সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি তখন এই মঠেরই এক অধম ভাই। একদিন সকালে উঠে দেখি, সামনের মরুভূমি দিয়ে হেঁটে চলেছে এক সেনাবাহিনী, ব্যস। সেটা, একটু চিন্তা করে যোগ করলো, আমার পঞ্চাশ জন্ম আগের কথা—না, অন্য এক সেনাদলের কথা বলছি—তিহাত্তর জন্ম আগের কথা।
এখানে হো-হো করে হেসে উঠতে গেল লিও। তাড়াতাড়ি ওর পায়ে পা দিয়ে খোঁচা দিলাম। ভাগ্য ভালো হাসিটাকে হাঁচিতে পরিণত করতে পারলো ও। তা না হলে পরে যে কথাগুলো জানতে পারলাম তার একটাও হয়তো জানা হতো না।
তা কি করে সম্ভব!? অবাক গলায় বললাম আমি। মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতিও কি বিলীন হয়ে যায় না?
না, ভাই হলি, সব ক্ষেত্রে তা হয় না। পুনর্জন্ম লাভের পর স্মৃতি কখনও কখনও ফিরে আসে বৈকি! বিশেষ করে যারা পবিত্র পথে অনেক দূর এগিয়েছে তাদের স্মৃতি তো প্রায়শঃই ফিরে আসে। আমার কথাই ধরো, তুমি এই অনুচ্ছেদটা পড়ার আগ পর্যন্ত ঐ সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুই মনে ছিলো না। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সৈনিকরা, আর আমি অন্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি ঐ বিরাট বুদ্ধ মূর্তির পাশে, দেখছি ওদের চলে যাওয়া। খুব বড় নয় বাহিনীটা। বেশির ভাগই পথের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরে গেছে, নয়তো নিহত হয়ছে শক্রর হাতে। সে আমলে আমাদের দক্ষিণে এক জংলী জাতি বাস করতো, তারা তাড়া করেছিলো ওদের। প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলো গ্রীকরা। ওদের সেনাপতি—কি যেন তার নাম…মনে করতে পারছি না।
আমাদের এই মঠে উঠে এসেছিলো ওদের সেনাপতি, বলে চললো বৃদ্ধ। তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের জন্যে ঘুমানোর মতো একটা জায়গা দাবি করেছিলো। খাবার, ওষুধপত্র আর মরুভূমির পথ ঘাট চেনে এমন একজন পথপ্রদর্শক-ও চেয়েছিলো সে। আমাদের সে সময়কার খুবিলগান তাকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের ছাদের নিচে কোনো স্ত্রীলোককে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না, কারণ তা আমাদের আইনের পরিপন্থী। সেনাপতি রেগে গিয়ে বললো, জায়গা না দিলে আমাদের মাথার ওপরে ছাদ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না; পুরো মঠ জ্বালিয়ে দেবে সে, আমাদেরকেও হত্যা করবে।
তোমরা জানো দাঙ্গা হাঙ্গামায় যারা নিহত হয় পরের জন্মে তারা জন্তু জানোয়ার হয়ে জন্ম নেয়। ভয়ঙ্কর ব্যাপার সেটা! মঠে স্ত্রীলোককে আশ্রয় দেয়া-ও পাপ, তবে অত কঠিন পাপ নয়। তাই আমরা ঠিক করলাম, সেনাপতির স্ত্রীকে আসতে দেবো মঠে। পরে মহা-লামার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ক্ষমা চাইবো। আমি অবশ্য নিজের চোখে সেই রমণীকে দেখিনি, তবে ওদের পূজারিণীকে দেখেছিলাম–হায়! কেন যে দেখেছিলাম! বুক চাপড়াতে লাগলো কোউ-এন।
কেন, হায় কেন? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কেন? ওহ! সেনাদলের কথা ভুলতে পারলেও ঐ পূজারিণীর কথা কখনও ভুলতে পারিনি। এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই তাকে। এই একটাই পাপ আমার জীবনে, এই পাপ আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে, না হলে অনেক আগেই মোক্ষ সাগরের উপকূলে পৌঁছে যেতে পারতাম।
তার ঘর গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। সবেমাত্র কাজ শেষ করেছি, এমন সময় ঘরে ঢুকলো সে। এক দিকে ছুঁড়ে দিলো মুখাবরণ। তারপর, হ্যাঁ, আমার সাথে কথা বললো সে। আমি তার দিকে তাকাতে চাইছি না বোঝার পরও অনেক প্রশ্ন করলো।