ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। এখনি একে অপারেশন করে ফেলতে হবে।
ডক্টর নীল জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু তাতে কি বিশেষ কোনো লাভ হবে?
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–দেখা যাক্। যদি না হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হত্যা করব।
দুজনে ধরাধরি করে অপারেশন টেবিলে দৈত্যটাকে তুললেন। দৈত্যটি মড়ার মতন নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। এই অস্ত্রোপচার সে সহ্য করতে পারবে কি না সন্দেহ! যদি না পারে, যদি তার মৃত্যু হয়–সে-ও তবু ভালো। যার সাধনায় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তাঁর সমস্ত জীবন, বিদ্যা, বুদ্ধি ও শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন–সে যে তাকে এত বেদনা দেবে, তা তিনি ধারণা করতে পারেননি। তিনিই তার প্রাণ দিয়েছেন, যদি তার প্রাণ যায়ই–যা তাঁরই হাতে। তিনি পাশের ঘর থেকে অপারেশনের সাজসরঞ্জাম আনতে গেলেন।
.
ঘরে যেন চকিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল। দৈত্যটি মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসল এবং পরক্ষণেই ডক্টর নীলকে একটুও সময় না দিয়ে প্রবল শক্তিতে তার গলা টিপে ধরল। ডক্টর নীল একটুও শব্দ করতে পারলেন না। মুখের কষ বেয়ে এক ঝলক রক্ত নেমে এল শুধু।
দৈত্যটি তাকে মাটিতে ফেলে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল। এখনি তার জীবনদাতা, তার স্রষ্টা আসবেন এ-ঘরে। আর এ-ঘরে থাকা তার পক্ষে উচিত হবে না। বড় কৌশলী আর বুদ্ধিমান এই মানুষ জাতটা। সে জানলা দিয়ে বাগানে লাফিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই রাস্তায়। আজ মুক্তি মুক্তি!! তাকে বাধা দিতে আর কেউ কোথাও নেই। তার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। তারপর দ্রুতগতিতে সে ঘনায়মান অন্ধকারে মিশে গেল।
৫-৬. তারপর
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ফিরে এলেন সাজসরঞ্জাম নিয়ে। এসেই তার মাথাটা ঘুরে গেল। এ কী হয়েছে! ডক্টর নীল ঘাড় খুঁজে পড়ে আছেন। গলার উপর কালো পাঁচটা আঙুলের দাগ–আর সেই দৈত্যটা নেই। খোলা জানলাটা যেন তার বোকামির জন্য বিদ্রূপ করছে। এত করেও শেষপর্যন্ত এত ভুল! একটি ভুলের জন্য ডক্টর নীলের মৃত্যু হয়েছে, না জানি আরো কত বড় মাশুল দিতে হবে।
সমস্ত শরীর তাঁর ঝিমঝিম করে উঠল। উহ্ কী ভুলই তিনি করেছেন দৈত্যটাকে ভালো করে না-বেঁধে রেখে। মুক্ত হয়ে এখন দৈত্যটা যে কী না করবে বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।
এই ল্যাবরেটরিতে এখন তিনি নিঃসহায়, একা। একা তিনি আর কী করতে পারেন? যদি দৈত্যটা আসে তাঁকেও হত্যা করতে, একা তিনি কী করে আত্মরক্ষা করবেন?
একবার মনে হল, হয়তো আর সে ফিরবে না। উত্তুঙ্গ পর্বতশিখরে, দেবদারু, পাইন, চেরি, পিচের বনে, বড় বড় বাড়ির ছাদে, কুয়াশার ভিড়ের মধ্যে হয়তো সে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। তারপর যখন আলো ফুটবে, যখন পথে লোকজন চলাফেরা করবে, তখন ওই অপমূর্তিকে দেখে সকলে প্রাণের ভয়ে ছুটোছুটি করবে, সমস্ত দেশে একটা হৈ-চৈ শুরু হবে। আর পিশাচটা নরহত্যা করে সুন্দর পৃথিবীর বুক রক্তে রাঙা করে দেবে।
ভয়ে আর চিন্তায় তিনি দিশেহারা হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি উঠে মৃত ডক্টর নীল এবং বেয়ারাকে তারই বাগানে কবরস্থ করলেন। তারপর সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে তিনি বসে রইলেন।
বাইরে বেরোতে সাহস হচ্ছে না, কী জানি কোথায় সেই দানবমূর্তি লুকিয়ে আছে। খাওয়ার কথা মনে এল না। একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন তাঁর গবেষণার ব্যর্থতার কথা, সমস্ত জীবনের সাধনার ধূলিসাৎ হওয়ার কথা। মৃত্যুকে তিনি প্রাণে সঞ্জীবিত করেছেন সত্য, কিন্তু এ কী নিদারুণ পরাজয়! অতিমানবের পরিবর্তে এ কী এক রক্তপিশাচের সৃষ্টি। তারই অদূরদর্শিতার জন্য দুই নিরীহ লোকের রক্তপাতে পৃথিবী এখনই কলুষিত হয়ে উঠেছে। মনের মধ্যে এক গ্লানি ধূমায়িত হয়ে উঠছে–ডক্টর নীল আর সেই বেয়ারার মৃত্যুর জন্য তিনিই কি দায়ী নন? হত্যাকারী কি শুধু সেই পিশাচটি? না–না–তিনি–তিনিই প্রকৃত হত্যাকারী!
দুপুর, বিকেল, রাত—একইভাবে কেটে গেল উদ্বিগ্ন চিন্তায়। ভোর হল, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে রয়েছে। ঘরের দরজা খুলতে তার সাহস হল না। কে জানে যদি সেই দানবটা আবার আত্মপ্রকাশ করে।
এক অনিশ্চিত আশঙ্কায়, এক দুঃসহ অসহায়তায়, এক অস্থির উদ্বিগ্নতায় ল্যাবরেটরির সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দিন কাটে। নিঃসঙ্গ সময় বিরাট পাথরের মতো চেপে বসে থাকে–নড়ে না। এক অনিশ্চিত সংশয় বাজপাখির মতো পাখা মেলে সমস্ত আকাশ কালো করে রয়েছে, তার ক্রুর শ্যেনদৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। একটু সুযোগ পেলেই সে যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর ওপর।
দিনের সূর্য পশ্চিমে যাওয়ার সময় দীর্ঘ ছায়া ফেলে। ছায়া দীর্ঘতর হয়। তারপর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছায়া, সমস্ত আকাশে অন্ধকার। তার মাঝে এই ল্যাবরেটরি এক দৈত্যপুরী, রূপকথার চিরন্তন রাজপুত্রের মতো ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিষ্ঠুর করাল দৈত্যের পদধ্বনি শুনে যান। অন্ধকার রাত্রি যেন কাটে না। চারদিকে বিভীষিকার ছোটাছুটি, চারদিকে ভয়…ভয়…। সেই অন্ধকার ভেদ করে কখন বেরিয়ে আসবে হিংস্র কদাকার রক্তলোলুপ্ত পৈশাচিক এক মুখ, নিঃশব্দ অন্ধকার ভেঙে সাদা দাঁত বের করে খটখট করে বলবে–আমি এসেছি; রক্ত চাই আমি। হে আমার স্রষ্টা, আমার বজ্রকঠিন হাতে একবার ধরা দাও।