ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল–একটা ভূত জলের পাইপ বেয়ে নামছে।
ভূত! তারা তক্ষুনিই বুঝতে পারলেন কে সে! দুজনেই সচকিত হয়ে উঠলেন। কখনই-বা তার জ্ঞান হল, আর কী করেই-বা সে পালাল! ছুটে গেলেন দোতলায়, দরজায় তালা লাগানো ঠিকই আছে। দুজনে হান্টারদুটো তুলে নিলেন, বেয়ারাটাকে নিয়ে আসতে বললেন একটা কম্বল।
তিনজনে ছুটে বাগানে জলের পাইপটার নিচে এসে দাঁড়ালেন। ডক্টর নীল নিলেন কম্বলটা। তাঁদের হাতে আবার সেই হান্টার দেখে দানবটা পাইপ বেয়ে নামতে নামতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে গোঁ-গোঁ করে উঠল, তার চোখদুটোতে এক উন্মত্ত হিংস্রতা ফুটে উঠল। বোধহয় একটু সে দ্বিধান্বিত হল–উপরে উঠে যাবে, না নিচে নামবে। তারপর হঠাৎ সে লাফিয়ে পড়ল বাগানের ওপর।
ডক্টর নীল ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন। দৈত্যটি মাটির উপর থেকে উঠবার চেষ্টা করার আগেই তিনি কম্বলটা নিয়ে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার সর্বশরীর ঢেকে ফেললেন। দৈত্যটাকে কিছু বুঝতে দেওয়ার আগেই তাকে বন্দি করা হল, তারপর হান্টারদুটো তার গায়ে সাপের মতো লাফিয়ে উঠল।
দানবটা রুদ্ধ আক্রোশে ছটফট করতে লাগল কিন্তু হান্টারের তীব্র জ্বালায় ধীরে ধীরে আবার সে নিশ্চল হয়ে এল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–কী বোকামিই-না করেছি! শুধু শক্তি দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি, কিন্তু বুদ্ধি আর বিবেচনা দিতে পারলাম না!!
দৈত্যটাকে নিয়ে গিয়ে আবার সেই ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। এবার তাকে খুব ভালো করে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে আর সে কোনো রকমে মুক্তি না পায়। সেই ঘরের বাইরে একটা বেয়ারাকে পাহারা রাখা হয়েছে তার ওপর লক্ষ রাখার জন্য, যাতে পালাবার সামান্যতম চেষ্টা করলেই তারা প্রস্তুত হতে পারেন।
দুদিন তাকে রাখা হল একেবারে অনাহারে। জলও তাকে দেওয়া হয়নি একফোঁটা। খেতে না পেলে সে নরম হবে, তার আগে নয়। তারপর অপারেশন করে এর শক্তি কমানোর না-হয় চেষ্টা করবেন।
তৃতীয় দিনে দানবটি নির্জীবের মতো হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের উপর। তার চোখ শুধু স্থির রয়েছে বেয়ারাটির দিকে। সে শুধু একবার মুক্তি চায়… মুক্তি, মাত্র একবার। তারপর সে দেখে নেবে কোথায় মানুষের অত্যাচারের সীমা, কতটুকু মানুষের ক্ষমতা কেমন-বা তাদের পৃথিবী!
বেয়ারাটি এক গ্লাস জল তুলে নিল। দৈত্যটির তাই দেখে চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। যেন শত শত শতাব্দীর পিপাসা তার বুকে। কত থর, গোবি, সাহারা যেন সে নিরস্তু উপবাসে পার হয়ে এসেছে। আজ যেন শত শত যুগের তৃষাতুর মরু-যাত্রী দেবদারু ও দারুচিনি সমাকীর্ণ একটি ছায়াময় শীতল উপবন দেখেছে, তার মাঝে এক সুন্দর দিঘি জলে টলটল করছে।
একবার সে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল বাঁধন হেঁড়বার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক গর্জন করল–আঁ আঁ আঁ…
চমকে উঠল বেয়ারাটি। সেই পিশাচটির চোখে তখন দানবের ক্ষুধা, বাহুতে দানবের শক্তি, বুকে তার দানবের পিপাসা। প্রবল টানে বাঁধন গেল ছিঁড়ে, সে আর একবার আকাশ ফাটিয়ে বিজয়গর্বে চিৎকার করে উঠল–আঁ আঁ আঁ….
একনিমেষে সে জানলার গরাদ ভেঙে ফেলল, তারপর সেই দৈত্যটি কেড়ে নিল জলের গ্লাস। এক চুমুকে সে তা নিঃশেষ করল। তারপর ভয়-বিহ্বল মূক বেয়ারাটিকে তুলে নিল দুহাত দিয়ে এবং মাটিতে আছড়াতে লাগল। বেয়ারাটি চিৎকার করে উঠল। কিন্তু আজ সে রক্তের স্বাদ পেয়েছে। তার হাত থেকে বেয়ারাটির রক্ষার কোনো আশা ছিল না।
হঠাৎ সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল, তাকে ধরবার জন্যই এরা ছুটে আসছে। সে পালাবার জন্য দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার সামনে এসেই কিন্তু সে থমকিয়ে দাঁড়াল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং ডক্টর নীল তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। হতাশায় এবং বেদনায় সে আর্তনাদ করে উঠল।
‘ফায়ার প্লেস’ থেকে দুটো জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিলেন তারা। কাঠদুটোকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে সে ভয়ে পিছু হটতে শুরু করল, সারা ঘর কাঁপিয়ে তার বিরক্তি জানাল–আঁ আঁ আঁ…
তারাও সেই আগুন নিয়ে তাকে কোণঠাসা করতে লাগলেন। আর উপায় নেই। দেখে নতুন শক্রর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবার জন্য সে আগুনের ওপর মারল এক থাবা। কিন্তু শত্রু যেন সমস্ত শরীরে তার বিষাক্ত সুচ ফুটিয়ে দিল। কী অসহ্য যন্ত্রণা!
চারদিকে তার শত্রু। আগুন তার লকলকে জিভ বের করে তেড়ে আসছে। হতাশায়, রাগে ও ক্ষোভে সে গর্জন করতে লাগল।
এ কোন্ জীব সে বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এটি যে তার শত্রু, তা সে স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। তারা যে প্রকৃতির মতো নিষ্ঠুর হয়ে অসহায় নিরস্ত্রের ওপর পাশবিক উল্লাসে অত্যাচার করতে পারে, তা সে দেখেছে। কুকুরের মতো জীবের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়েছে। কিন্তু এ কী ধরনের শত্রু যার চোখের জ্যোতিতে সমস্ত ঘর জ্বলে ওঠে–যার নিশ্বাসে অসহ্য তাপ, আর যার ললকে জিভ সমস্ত শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মানুষ তাকে ভয় পায়, কুকুর তাকে ভয় পায়, কিন্তু এই নতুন শত্রু যেন তার দিকে রাক্ষসের মতো তেড়ে আসে। একবার এই আগুনকে তার শক্তি সে দেখিয়ে দেবেই।
.
সর্বাঙ্গ জ্বলতে শুরু করলেও সে সেই অগ্নিব্যুহ ভেদ করবার জন্য প্রবল বিক্রমে সংগ্রাম চালাল। কিন্তু কতক্ষণ সে আর অনাহারে দুর্বল শরীরে দাঁড়াবে? তার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে–একবার সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যায়।