চারদিক নিস্তব্ধ রইল কিছুক্ষণ। তারপর খটখট শব্দে তিনি বুঝতে পারলেন সেই কঙ্কালটি চলে গেছে। তবু ভয়ে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না–কখন আবার সেই পিশাচ এসে পড়বে! কান পেতে তিনি সজাগ হয়ে রইলেন, কিন্তু কোনো শব্দই আর পেলেন না। ভয়ে তার বুক ধুকধুক্ করতে লাগল। মানুষের বদলে এ তিনি কী সৃষ্টি করেছেন? সৃষ্টির এ কী বিজাতীয় পরিহাস!
কখন একসময় ক্লান্তিতে ও আতঙ্কে তার ঘুম এসেছে, কিন্তু সেই ঘুমে কী যন্ত্রণা! মনে হল যেন লক্ষ লক্ষ নরকঙ্কাল হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে সমস্ত পৃথিবী মাড়িয়ে, ভেঙেচুরে খানখান করে দিচ্ছে। মানুষের রক্তে এই শ্যামল পৃথিবী রাঙা হয়ে উঠছে, তিনি একা সেই রক্তসাগরে দাঁড়িয়ে এই তাণ্ডবলীলা দেখছেন, আর তারা তার দিকে তাকিয়ে বলছে–হে প্রভু, হে স্রষ্টা! তুমি দ্যাখো, তুমি দ্যাখো–তোমার সৃষ্টি পৃথিবীর কী সৌন্দর্য এনে দিয়েছে! তুমি যা চেয়েছিলে তা পেলে কি না!
হঠাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদে তার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে তিনি উঠে বসলেন তার বিছানায়। পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন ডক্টর নীল–চোখদুটো আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, মুখের সমস্ত রক্ত ব্লটিং দিয়ে কে যেন নিঃশেষ করে মুছে নিয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে দেখে তিনি বললেন–ভূত, ভূত!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন–ভূত নয়, ভূত নয়, ডক্টর নীল! আমার সৃষ্টি অতিমানব। উহ্, আমি কী করেছি। মানুষ গড়তে গিয়ে আমি এক পিশাচ গড়েছি!
ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ডক্টর নীল। বললেন–এ সেই–সেই–
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উঠে বসলেন, বললেন–হ্যাঁ, সেই। এতদিনের প্রচেষ্টা, এতদিনের সাধনা—সব মিথ্যা, সব ব্যর্থ হয়ে গেল। কী নিদারুণ পরাজয়, ডক্টর নীল।
কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব।
হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–চলুন। দেখা যাক আমরা ওকে কী করতে পারি।
দুজনে ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখেন সেই পিশাচটা টলতে টলতে একটা ঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। তার পায়ের নিচে সমস্ত মেঝে যেন মটমট করে উঠছে।
পিশাচটা তাঁদের দেখে থামল। সেই বিবর্ণ পীতাভ চোখদুটো যেন কেমন হয়ে উঠল! সে আস্তে আস্তে দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অস্থির মুখটা বোবা কথায় শুধু খটখট করে উঠল।
তাঁরা বিপদ গণলেন। ওই পিশাচের শক্তি-পরীক্ষা আগেই হয়ে গেছে। পিশাচটাকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁরা পিছু হটতে লাগলেন। ডক্টর নীল আর পারলেন না, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন ওই দৈত্যটাকে।
এই হঠাৎ-আঘাতে দৈত্যটা থমকে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে বের হল এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, তারপর দুহাত বাড়িয়ে সে দুজনের দিকে তেড়ে এল। চোখের দৃষ্টি তার যেন আরো নিষ্প্রভ, আরো করুণ হয়ে এসেছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে তারা দরজা বন্ধ করে দিলেন। দৈত্যটা দরজা খোলার জন্য সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। ঘরের ভেতর রাগ ও ক্ষোভের চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছুটলেন দুটো হান্টার আনতে। ডক্টর নীল গেলেন তার কুকুর স্পর্কিকে আনতে। হান্টার আর কুকুর এনে তারা দরজা খুলেই দরজার দুদিকে লুকিয়ে পড়লেন।
দানবটা দরজা খুলে বাইরে এল। স্পর্কি সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল; কিন্তু দৈত্যটা তাকে ঘাড় ধরে সজোরে আছড়িয়ে ফেলল মাটির উপর। তার আর নড়বার সামর্থ্য রইল না। সে আতঙ্কে ও বেদনায় কেউ কেউ করে করুণ নয়নে ওই অদ্ভুত জীবটির দিকে তাকিয়ে রইল।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং ডক্টর নীল হান্টার দিয়ে তাকে সপাং-সপাং করে মারতে লাগলেন। যন্ত্রণায় এবং রাগে সে আর্তনাদ করে উঠে দুহাত বাড়িয়ে দিল তাদের ধরবার জন্য কিংবা হয়তো সে আকুল মিনতি জানাতে চাইল এই অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের! কিন্তু হান্টারের অসহ্য পিটুনিতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কোথায় যাবে সে? কোথায় গিয়ে সে লুকোবে? তারা দুজন নিষ্ঠুর করালের মতো হান্টার চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু আর সে বেশিক্ষণ এই হান্টারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারল না–টলতে লাগল। তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে সে পড়ে গেল। পাশেই কুকুরটা ভয়ে কেউ কেউ করছিল। জ্ঞান হারাবার আগে দানবটা একবার তার হাত বাড়িয়ে কুকুরের গলা টিপে ধরল। স্পর্কি আর চিৎকার করতেও পারল না।
তাঁরা দুজন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
৪. ল্যাবরেটরির বিভীষিকা
যখন তাদের সম্বিৎ ফিরে এল তখন তারা তাকে দড়ি দিয়ে খুব ভালো করে বেঁধে সেই ঘরে আটকিয়ে রেখে চলে গেলেন। বাইরের দরজায় ভালো করে লাগালেন তালা; সমস্ত জানালাগুলো ভালো করে আটকে রাখলেন। থাক সে কয়েকদিন বন্দিভাবে, অনাহারে। পরে নিজে থেকেই সে শান্ত হয়ে আসবে। তাকে ভয় করবার তখন আর কোনো কারণই থাকবে না। তারপর নিচের ঘরে গিয়ে তারা বসলেন।
.
এই দানবের কাহিনী আর গোপন রাখা চলবে না। এর কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ তাকে ক্ষমা করবে না। দৈত্যটা যে জগতের একটা বিভীষিকা হয়ে থাকবে, তা ভালো করেই বুঝতে পারলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এখন একে হত্যা করা কী করে সম্ভব?
আকাশ পাতাল ভাবছেন তারা। এমন সময়ে দেখা গেল একটি বেয়ারার বিবর্ণ মুখ। তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, হাত-পা ঠঠক্ করে কাঁপছে।