চোখদুটো কিন্তু এখনো তেমন পীতাভ, তেমন স্থির, জ্যোতিহীন, নিষ্প্রভ। হাত-পা–সবই অসাড়। যেন যোগাবিষ্ট হয়ে শুয়ে আছেন এক মহামানব। আর কত সময় লাগবে? বাঁচবে কখন, জাগবে কখন তাঁর সৃষ্ট এই মানুষ?
গাঁ গাঁ গাঁ…
গাঁ গাঁ গাঁ…
অস্ফুট এক শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। সেই মড়াটির গলার ভিতর ঘড় ঘড় করে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে তার হাত নড়ে উঠল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার হাত এগিয়ে দিলেন তার দিকে। সে তার দুটি আঙুল দিয়ে সজোরে ধরল তার হাত। তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় হাত ছাড়িয়ে নিলেন। হাতে তার কালশিরা পড়ে গেছে। কী অমানুষিক শক্তি তার হাতে! এত শক্তি তিনি তার দেহে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন?
একবার তার ভয় হল–যে এখনো ভালোভাবে বাঁচেনি, তারই যখন এত শক্তি যে সামান্য দুটি আঙুলের জোরে সে তার হাতে কালশিরা ফেলে দিতে পারে–সে যখন বাঁচবে তখন সে তো অজেয় হয়ে উঠে যেখানে-সেখানে যা-খুশি তাই করে বেড়াবে, তাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না–এমনকি নরহত্যাও করে বেড়াতে পারবে।
কিন্তু তারপর মনে হল: শক্তি আর হবেই, কিন্তু সে বেঁচে উঠলে মানুষই হবে— তার শক্তির অপপ্রয়োগ সে তো না করতেও পারে। তার সাধনাও তো এক শক্তিশালী অতিমানুষ তৈরি করা।
গাঁ গাঁ গাঁ…
গাঁ গাঁ গাঁ…
তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকিয়ে ওঠেন তিনি। টেবিলের উপর শুয়ে শুয়ে সেই মড়াটি ছটফট করছে। চোখদুটো তার ঠেলে যেন বেরিয়ে আসছে নাক দিয়ে তার ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। মড়া জাগে–মড়া জাগে!–
ঘোঁ…ওঁ…ওঁ…ওঁৎ
মড়াটি আবার চিৎকার করে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে মড়াটি হাত তুলল, আবার টেবিলের উপর রাখল। হাঁ করে দাঁত বের করতে লাগল–তারপর ধীরে ধীরে পা তুলল।
ফ্ল্যাঙ্কেনস্টাইন একদৃষ্টে তার দিকে নীরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।
মড়াটি এবার আস্তে আস্তে উঠে টেবিলের উপর বসল। একবার চারপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল। এ সে কোথায় এসেছে। এই ঘর, এই বাড়ি-এর মধ্যেই কি সে মানুষ হয়েছে।
চারদিক অন্ধকার, বাইরে সারা আকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ছে। দিকচক্রবালরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কুয়াশায়। মড়াটি একবার পরিপূর্ণভাবে শীতল বাতাস অনুভব করল। তারপর টেবিলের উঠে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি পড়ল ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ওপর। চোখদুটো তার আনন্দে জ্বলে উঠল। তার স্রষ্টা! তার ভগবান!!
তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু তার স্রষ্টার মুখ ওরকম পাণ্ডুর কেন? চোখেমুখে ভয়ার্ত বিহ্বলতা কেন? সে টলতে টলতে এগিয়ে গেল ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, তার স্রষ্টার দিকে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর থাকতে পারলেন না। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে দরজাটা জোরে ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মড়াটি তখন দরজার ওপর প্রচণ্ডবেগে ধাক্কা দিচ্ছিল।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ক্ষোভে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার শোবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এ কী হল? প্রাণসঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে এত সুন্দর মূর্তি এত কুৎসিত হয়ে গেল কী করে? এত সুন্দর চোখে তার ওই বীভৎস দৃষ্টি সে পেল কী করে? তার আজীবন সাধনার ব্যর্থতার কথা মনে করে তিনি কাঁদতে লাগলেন।
হল না, কিছুতেই মানুষ হল না–শেষপর্যন্ত কি না তিনি এক পিশাচ গড়ে ফেললেন! তার ভয় হতে লাগল, যখনই মড়াটি এক পা এক পা করে টলতে টলতে হাঁটবে, তখনই তার শরীর থেকে গলিত মাংসখণ্ড এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে পড়বে–আর ওর পোশাকের মধ্যে যে শবকীট কিলবিল করছে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন তার এই শোচনীয় ব্যর্থতার কথা। মাঝে মাঝে মনে করেন, ও-কথা আর ভাববেন না। তাই জোর করে ভাবতে বসেন। বাড়ির কথা–তার বাবা তাকে বারবার করে বাড়িতে ফিরতে লিখেছেন। ছোটভাই। আর্নেস্ট তার আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে একই কথা লিখেছে। উইলিয়ম লেখেনি, লিখতে পারলে নিশ্চয়ই ওই একই কথা লিখত। আর এলিজাবেথ! এলিজাবেথ লিখেছে– শবরীর প্রতীক্ষা করছে সে।
হঠাৎ তার মনে হল এলিজাবেথ যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করছেন।–কিন্তু এ কী! এ তো অনিন্দ্যসুন্দরী এলিজাবেথ নয়, এ যেন এক বহুদিনের মৃত কুশ্রী শব। আতঙ্কে তাঁর সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল।
টেবিলের উপর রাখা বাতির অল্প আলো ঘরটাকে আবছায়া করে তুলেছে। হঠাৎ তিনি দেখেন জানলা ভেঙে তাঁর জীবন-ভোর সাধনার ফল, তারই অতুলনীয়। সৃষ্টি সেই মড়াটি সেই ঘরে প্রবেশ করল, তারপর তার অস্থি-সর্বস্ব আঙুল দিয়ে তাঁর মশারি তুলে ধরল। ভয়ে তখন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। কী নিষ্প্রভ তার চোখ–যদি তাকে চোখ বলা যায়!
তার চোয়ালদুটো খুলল, আস্তে আস্তে মুখ হাঁ করল, কালো ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। তারপর সে যেন কী বলার চেষ্টা করল কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না। সেই জীবন্ত কঙ্কালের মুখ দিয়ে শুধু বের হল খট খট করে কতগুলো শব্দ, যেন সমস্ত হাড়গুলো তার প্রচণ্ড বাতাসে নড়ে উঠল।
কোনো মানুষই এইরকম এক অপার্থিব জানোয়ারকে সহ্য করতে পারে না, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনও আর সহ্য করতে পারলেন না। ভয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি লেপ দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা দিলেন। কী বিভীষিকা সৃষ্টি করেছেন তিনি! লেপে একটু টান পড়াতে তিনি বুঝতে পারলেন যে সেই দৈত্যটা তা টেনে খুলতে চাইছে। তাই তিনি জোর করে সেটি টেনে ধরে থাকলেন। ধীরে ধীরে লেপের ওপর টান চলে গেল।