ডক্টর নীল বললেন–কিন্তু, মানুষ গড়া কি সত্যিই সম্ভব?
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–নয় কেন? আমার সব কাজ শেষ হয়ে এসেছে। শুধু আপনি আজ আর একটা কাজ করে দিন। আপনি সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে শুধু একটি মানুষের ব্রেন’ এনে দিন। অত্যন্ত গোপনে এবং লুকিয়ে আনতে হবে। তারপর আশা করি, এ ব্যাপারে আর আপনার দরকার হবে না।
ডক্টর নীল বললেন–বেশ, আজই আপনি তা পাবেন।
.
সায়েন্স ইনস্টিটিউট। ডক্টর রে উৎসুক ছাত্রদের বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। ডক্টর নীল ছাত্রদের মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জারে ‘ব্রেন’গুলো রয়েছে অ্যালকহলের মধ্যে। ডক্টর নীলের গা ছম ছম করে উঠল। আজই বক্তৃতার পর ওরই একটি চুরি করতে হবে। যদি ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের আবিষ্কার সফল হয়… যদি তিনি মানুষ গড়তে পারেন… যদি অতিমানুষ মানুষের হাতে বন্দি হয়, যখন ইচ্ছা তাকে মারো, যখন ইচ্ছা বাঁচাও…তবে…তবে…? সমগ্র জগতে ছড়িয়ে পড়বে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নাম–আর তার এককোণে ছোট্ট তারার মতো জ্বলবে তারও নাম। জগতের মনীষীদের মাঝে তাদের নাম থাকবে চিরস্মরণীয় হয়ে–এঁরা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এঁরা মানুষকে অজেয় করেছেন, এঁরা মানুষকে শক্তিমান করেছেন!
ডক্টর নীল লুব্ধদৃষ্টিতে অ্যালকহলে-রাখা বেনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। ডক্টর রে যে কী বলছেন তা তার কানে যাচ্ছিল না। তিনি শুধু প্রতীক্ষা করছেন, কখন এই অভিনয়ের শেষ হবে-কখন শেষ হবে বক্তৃতা-কখন রঙ্গমঞ্চে নামবার আসবে লগ্ন!
ঢং ঢং ঢং….
ঘণ্টা বেজে গেল। বক্তৃতার সময় শেষ হয়েছে, এসেছে তার রঙ্গমঞ্চে নামবার চরম মুহূর্ত। চোখের সামনে নাচছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জারগুলো। এক মুহর্ত–শুধু এক মুহূর্তের জন্য চাই সময়! তারপর নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখের পথে– বাধা নেই, বিঘ্ন নেই–আছে শুধু ছন্দ-হিল্লোলিত জীবনের আলোকিত পথ–আছে। জীবনের গৌরবময় সাফল্য।
.
ডক্টর রে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। ছেলেরাও চলে গেল ক্লাস থেকে। ডক্টর নীল এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ক্লাসটি নির্জন হতেই ছুটে গেলেন তিনি। কোনটা নেবেন ভাববার সময় পেলেন না। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই। কে কখন এসে পড়বে, কে কখন দেখে ফেলবে–তাদের সমস্ত পরিকল্পনা নিমেষে নষ্ট হয়ে যাবে। একটা জার থেকে একটা ব্রেন নিয়ে গোপনে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে।
যাক, এখন তিনি নিশ্চিন্ত। এখন আর ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সকলের অজ্ঞাতসারে তিনি বেরিয়ে যেতে পেরেছেন।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ব্রেনটা দেখে একটু চমকিয়ে উঠলেন–এ কি মানুষের ব্রেন! কিন্তু আর ভাববার সময় নেই। পাঁচ বছর প্রায় কেটে গেছে এই মানুষটি গড়তে আর অপেক্ষা করতে তাঁর ইচ্ছা ছিল না। অতিমানুষই তো তিনি সৃষ্টি করতে চলেছেন, তবে মিছে এ ভয় কেন? আর যদি মানুষ গড়তে গিয়ে অমানুষ হয়ে যায় তবে প্রাণ যখন দিয়েছেন, নিতেও পারবেন। যদি এ মানুষ না হয়, তবে এর প্রাণ নিয়ে আর একটি মানুষকে প্রাণ দেবেন। সে-ও যদি মানুষ না হয়, তবে দেবেন আর একজনকে। প্রাণদানের রহস্য যখন তিনি উদ্ঘাটিত করতে পেরেছেন তখন আর ভয় কী? তাঁর সাধনা সফল করে তারপর তিনি নেবেন ছুটি।
.
নভেম্বরের মৃত্যু-শীতল অন্ধকার নিচ্ছিদ্র রাত্রি। সমস্ত শহরটায় একটি প্রলয়-লীলা চলছে। কাছের বড় বড় গাছ কাঁপিয়ে শীতের ঝড়ো বাতাস হা-হা করে দরজা-জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মোটা কাঁচের সার্শির ওপর মাথা খুঁড়ছে। দূরের কাছের সমস্ত পর্বতশৃঙ্গে সাদা জমাট বরফের ওপর দীর্ঘ শীতল রাত্রি জমে আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সামনে টেবিলের উপর শুয়ে রয়েছে একটি সুন্দর অতিমানুষ। কী সুন্দর তাকে দেখতে–কী সুন্দর তার মুদিত চোখ, কী সুন্দর তার নির্বাক মুখ, আর কী সুঠাম তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ!
ওই সুন্দর মানুষটির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এখন আর বাকি শুধু প্রাণপ্রতিষ্ঠা। হয় মানুষ জিতবে, নয় ভগবান। আজ ভগবানের পরাজয় মানুষের হাতে প্রতিমুহূর্তে। শুধু এই মানুষ মরা-বাঁচার ব্যাপারেই এখনো তিনি অপরাজেয় হয়ে আছেন। যদি এই সাধনায় আজ তিনি জয়যুক্ত হন, তবে পৃথিবীতে দেবত্বের অবসান–মানবের জয়জয়কার। মানুষের এই বিজয়, মানবসমাজের যে কতখানি মঙ্গল করবে এই ভেবে দেবতার নিজে থেকে পরাজয় স্বীকার করা উচিত।
সুদীর্ঘ রাতও ছোট হয়ে আসে। মোমবাতিটি গলে গলে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেই মূর্তিটির দিকে। কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কখন জাগবে মানুষ–তার সৃষ্টি এই অতিমানুষ।
৩-৪. অদ্ভুত এক সৃষ্টি
সমস্ত দেহটা যেন হঠাৎ একসময়ে কেঁপে উঠল। চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবে কি মড়া বাঁচল? তার সাধনা কি সফল হল?
না, চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ। চোখ দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সে জীবিত না মৃত। তিনি অধীর আগ্রহে সেই মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাতটা একবার যেন নড়ে উঠল। পরক্ষণেই মৃতদেহটি তার হাত তুলতে চেষ্টা করল। হাতটি কিছুদূর উঠে আবার পড়ে গেল!
তিনি আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন! যুগ যুগ ধরে সমগ্র মানবের যে কামনা ছিল–মানুষের প্রাণদান–তাই আজ তিনি সফল করেছেন। মড়া বেঁচেছে!!!