হেনরি ক্লেরভাল! ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের আজন্ম সুহৃদ ও সহপাঠী। বিজ্ঞান পড়ার ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও তার বাবা তাকে পড়তে দেননি, পারিবারিক ব্যবসায়ে প্রথম থেকেই ঢুকিয়ে দেন। কেরভাল দেখাশোনা করছে–এই যা ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সান্ত্বনা।
ডক্টর নীল এসে ঘরে ঢুকে একটু ভীত হয়ে উঠলেন। তাঁর গুৰু ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চেহারার এ কী পরিবর্তন! আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে একত্র কাজ করছেন–প্রাণপ্রাচুর্যপূর্ণ ও সদাহাস্যময় এই ব্যক্তিকে কখনো এত অসুস্থ, এত উদ্যমবিহীন দেখেননি। বললেন—স্যার! আপনার কি অসুখ করেছে?
না–ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–মা মারা গেছেন, চিঠি এসেছে।
–আপনার তো তবে একবার বাড়ি যাওয়ার দরকার।
বাড়ি!–একটা দীর্ঘনিশ্বাস চেপে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–হ্যাঁ, যাব। তবে আগে কাজ! মা মৃত্যুর আগে আমাকে দেখতে চাননি–আমার কাজের অসুবিধা। হবে বলে। মা-র এতবড় অসুখ–আমাকে কেউ আগে খবর দেয়নি ডক্টর নীল– আমার কাজের অসুবিধা হবে বলে। ডক্টর নীল, কাজ-কাজ–কাজ! আমার আর অপেক্ষা করার সময় নেই। যে কাজ শুরু করেছি, তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতেই হবে। আজ কাজ ফেলে চলে যাব?
ডক্টর নীল বললেন–তা ঠিক। কিন্তু যদি কিছু মনে না করেন তো বলি আপনি ঠিক কী কাজ করছেন মানে আপনি ঠিক কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, আমি আপনার সঙ্গে এতদিন থেকেও ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–আমি যে কী করছি তা আমি কাউকে বলিনি। আপনি আমাকে এত সাহায্য করছেন, তবু আমি আপনার কাছে সেকথা গোপন করে রেখে গেছি। হয়তো আপনি আমাকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন বিশ্বাস করুন, আমার সমস্ত অন্তর একসঙ্গে সব কথা আপনাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি–শুধু আপনি হাসবেন বলে। কারণ আমি জানি, আমি অসম্ভবের কল্পনা করছি–অসম্ভবকে সম্ভব করার সাধনা করছি। এই সাধনার জন্য সুদীর্ঘ পাঁচ বছর আমি ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে এই নির্জন নির্বান্ধব দেশে ল্যাবরেটরিতে আপনাদের দু-একজনকে নিয়ে পড়ে আছি। কতবার বাবা-মা’র কাছ থেকে চিঠি এসেছে, উত্তর দেওয়ার পর্যন্ত সময় হয়নি। আমার প্রাণের বন্ধু হেনরি ক্লেরভাল কতবার ছুটে এসেছে জেনেভা থেকে আমার খবর নিতে। কতবার সে জিজ্ঞাসা করেছে-কী আমার গবেষণার বিষয় যার জন্য আমি সব ভুলে বসে আছি? তার কাছে আমার কোনো কথা গোপন নেই, কিন্তু কিন্তু তাকেও আমার গবেষণার বিষয় বলতে পারিনি। সে বিশ্বাস করবে না, উপহাস করবে–এই ভয়ে। আপনি বৈজ্ঞানিক, আমার সহকর্মী এবং এই গবেষণার চরম সাফল্যে আপনার দানও কম নয়–এই স্বীকৃতির জন্য আজ আপনাকে আমি সব কথা খুলে বলব। হয়তো বিশ্বাস। হবে না, মনে মনে হাসবেন–তবু কাউকে আমার কথা না বলে পারছি না। কিন্তু তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে যে, একথা আর কাউকে আপনি এখন জানাবেন না।
ডক্টর নীল বললেন–আপনি আমাকে সহকর্মী বলে বেশি সম্মান দিচ্ছেন। আমি আপনার শিষ্য, আপনার নগণ্য এক সহকারী মাত্র। আপনাকে অবিশ্বাস করলে এতদিন আপনার কাছে পড়ে থাকতাম না। আপনি আমাকে সব কথা নির্ভয়ে বলতে পারেন; আমার কাছ থেকে কোনো কথা প্রকাশ পাবে না।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–ছেলেবেলা থেকে আমার কলকজা এবং বিজ্ঞানের দিকে অত্যন্ত ঝোঁক। অবাক হয়ে দেখতাম কেমন দম দিলে রেলগাড়ি ছুটে চলে, ছোট পুতুল প্রভৃতি নাচে। দিন দিন বিজ্ঞানের ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যেতে লাগল। তারপর যখন বড় হলাম, তখন এক চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল-কলকজা দিয়ে যদি পুতুল চালানো সম্ভব হয়, মানুষ গড়া কি অসম্ভব হবে? মানুষ যদি মানুষের প্রাণ নিতে পারে, তবে চেষ্টা করলে কি প্রাণ দিতে পারে না? দিনরাত শুধু ভাবতাম, কী করে মানুষ তৈরি করব।
শুধু সেইজন্যই বাবার শত অমতে, বন্ধু ক্লেরভালের নিষেধ সত্ত্বেও মা’র চোখের জল অগ্রাহ্য করে ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়তে গেলাম। আমার অধ্যাপকদের মধ্যে দুজন– প্রফেসর ক্রেম্প আর প্রফেসর ওয়ান্ডমান–ঠিক আমার মতোই অদ্ভুত প্রকৃতির ছিলেন। তাদের দুজনের কাছে আমি শুনতাম অ্যালকেমির যুগের অসাধ্যসাধনের প্রচেষ্টার কাহিনী, কত অলৌকিক ঘটনা–সে যুগের বিজ্ঞান যার কারণ দেখাতে পারেনি, অথচ অনেক বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভব। হয়েছে। বিশেষ করে প্রফেসর ওয়ান্ডমান আমার এই পাগলামির প্রধান সহায়ক হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল, বাড়িতে ফিরে গেলাম কিন্তু মাথায় সেই একই চিন্তা কী করে মৃতে জীবন সঞ্চার করা যায়, কী করে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা যায় যে মানুষ জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, কর্মশক্তিতে সাধারণ মানুষের চেয়েও বড় হবে। যাকে দিয়ে নতুন এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করা যাবে।…
তিনি বলে যেতে লাগলেন–এইজন্য কত বই পড়তে শুরু করলাম। কত জাদুকরের সঙ্গে আলাপ করেছি এবং তারপর নিজে কিছু কিছু জাদুবিদ্যা শিখতেও শুরু করলাম। মনে মনে অসম্ভব বল পেলাম। জাদুবিদ্যা এবং বিজ্ঞান এই দুই বিদ্যার সাহায্যে যে আমি মানুষ গড়তে পারব–সে বিষয়ে আমি একরকম নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম আমার প্রাণের বন্ধু ক্লেরভালের সাহায্য নেব, কারণ একা একা সব করা সম্ভব নয়, কিন্তু ও পাগল ছেলে, ওর ধৈর্য নেই। তাই কী যে করব বুঝে উঠতে পারলাম না। কাজটা আমি গোপনভাবেই করতে চাই; তাই শবদেহ সংগ্রহও গোপনে করাই উচিত। কিন্তু একা যে-কী করে সম্ভব ভেবে উঠতে পারলাম না। এমন সময় আপনার সঙ্গে আলাপ। অর্থাভাবে আপনি বিজ্ঞানচর্চায় মন দিতে পারছিলেন না, সে অর্থাভাব আমি দূর করলাম–একটি শর্তে যে, আপনি বিনা-প্রতিবাদে আমার কথা শুনবেন। আজ পর্যন্ত আপনি আপনার শর্ত সম্পূর্ণ মেনে চলেছেন, যার জন্য আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। তারপর আপনি শবদেহ সংগ্রহ করে আমার যে উপকার করেছেন, তা আমি জীবনে ভুলব না।