ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–সোজা রাস্তা দিয়েই যাব। যা হবার হবে।
শবাধারটিকে কাঁধে করে তারা সোজা রাস্তা দিয়েই চললেন–তবে কুয়াশা কেটে যাবে শিগগির।
পথে আর বাধা নেই। এখনো সমস্ত দেশ নিদ্রামগ্ন, এখনো সুষুপ্তি, এখনো সুখ-শষ্যা! বেঁচে থাকো তোমরা, এদিকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় পূর্ণত্ব লাভ করুক। সফল হোক এক বৈজ্ঞানিকের জীবনব্যাপী নিরলস সাধনা, সফল হোক বিশ্বমানবের এক কল্যাণপ্রচেষ্টা।
যাক–ল্যাবরেটরি ঐ যে দেখা যাচ্ছে।
.
২. ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
মধ্য-ইউরোপের তুষার-শৈলে ঘেরা শহরটি। ছোট্ট শহর, তার চেয়ে কম লোকজন। যেদিকে তবু জনমানবের বসতি আছে সেই দিকেই বাজার, সেই দিকেই হোটেল, খেলার মাঠ, সমাধিক্ষেত্র। দুরন্ত শীতে তার সব জায়গাই বরফে জমাট বেঁধে থাকে সব সময়ে।
একটু দূরে যেখানে মানুষের চলাচল প্রায় শেষ হয়েছে, যেখানে পর্বতশৃঙ্গ আরো উদ্যত হয়ে আকাশের উচ্চতা মাপবার জন্য প্রতিযোগিতা করছে–তারই একটি পাহাড়ের উপরে উঁচু-উঁচু পাইন চেরির জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অপরিসর একটি পায়েচলা পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে অনেকটা উপরে। সেইখানে দেখা যায় সুন্দর একটা বাড়ি।
ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ল্যাবরেটরি।
ডক্টর ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তার বসবার ঘরে নির্জীব পঙ্গুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে একটি চিঠি–কিন্তু তার দৃষ্টি সেই চিঠির ওপরে নেই, জানলার বাইরে কুয়াশার ভিতর দিয়ে দূরের অস্বচ্ছ তুষারমণ্ডিত পর্বতশ্রেণীর ওপর যেন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চোখের কোণে ছোট্ট মুক্তোর মতো একফোঁটা জল যেন জমে আছে, ঝরে পড়তে পারছে না। পাছে সেই বেদনার্ত সময়ের সমাধি ভঙ্গ করে ফেলে।
এই নিথর নিস্পন্দ মূর্তির দিকে এখন তাকালে মনে হবে না যে ইনি সেই ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন–যিনি আজ পাঁচ বছর ধরে অক্লান্ত বিজ্ঞান-সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন, যার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল সজীব চঞ্চলতায় পরিপূর্ণ, কাজ–কাজ কাজ ছাড়া আর যার অভিধানে কোনো শব্দ ছিল না।
সেই বিমর্ষ বিধুরতা যেন একটু নাড়া পেল, ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বুক থেকে অস্ফুট এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে সমস্ত ঘরকে যেন প্রবলভাবে নাড়া দিল। হাতের চিঠিটা আর একবার দেখবার চেষ্টা করলেন, চিঠির কয়েকটি লাইন তার চোখে ভেসে উঠতে লাগল। চিঠির শেষটুকু তিনি আর একবার দেখলেন :
যাই হোক্, তুমি বিশেষ চিন্তা কোরো না। তোমার কাজ যতদূর শীঘ্র শেষ করে একবার অন্তত আমাদের দেখা দিয়ে যাও। যদিও আজ বাড়ির সকলে অত্যন্ত গভীর দুঃখে আচ্ছন্ন, যদিও ভগবান ছাড়া আর কারো কাছ থেকে এই বেদনায় সান্ত্বনার আশা করা যায় না, তবুও মনে হয় তুমি এলে বাড়ির চেহারা একটু বদলে যেতে পারে। ইতি। তোমার বাবা আলফোন্স ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।
বাবার কথা মনে পড়ে যায় ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের। সেই জেনেভার শহরতলিতে সুন্দর ছোট বাড়ি, ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে বেড়ানো–প্রচুর অর্থ ব্যয় এবং ত্যাগ স্বীকার করে তাকে ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো আর তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণার জন্য এই ল্যাবরেটরি তৈরি করে দেওয়া প্রতিদানে তিনি বাবাকে কী দিতে পেরেছেন! কতদিন বাবার সঙ্গে দেখা হয় না, কতদিন মার–
মার কথা মনে পড়তেই আবার চিঠির দিকে তাকালেন, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল :
আজ প্রায় পাঁচ বছর হল তোমার দেখা পাইনি। শুনে দুঃখিত হবে যে তোমার মা আজ সাতদিন স্কারলেট ফিভারে ভুগে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারপর নিজে থেকেই বললেন–না থাক, তার কাজের অসুবিধা হবে।
তোমার ছোট দুই ভাই আর্নেস্ট আর উইলিয়মের খুব কষ্ট হয়েছে। বয়সে তো তারা তোমার থেকে অনেক ছোট। এলিজাবেথ যদিও প্রথমে ভেঙে পড়েছিল, তবু তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শক্ত হয়েছে। সে আর আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা পরিচারিকা জাস্টিন সকলের দেখাশুনা করছে। তোমার মার বড় ইচ্ছা ছিল, এলিজাবেথের সঙ্গে তোমার বিয়ে তিনি দেখে যাবেন।
মা–মা নেই। দিনের সূর্যকে যেন একনিমেষে নিবিড় কালো মেঘ ঢেকে ফেলল, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে নিরন্ধ্র অন্ধকার, জমাট কুয়াশাভরা আকাশে যেন অমানিশার দুঃস্বপ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে! মা নেই–ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মা নেই! এক অসীম শূন্যতা, এক নিঃসঙ্গ অসহায়তা ধীরে ধীরে তার সমস্ত হৃদয় আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
কত বছর মাকে তিনি দেখেননি? পাঁচ বছর–তা হবে। মাকে তিনি এই সুদীর্ঘ পাঁচ বছর ভুলে ছিলেন, কিন্তু মা তাকে ভোলেননি। তাঁর কাজের অসুবিধা হবে বলে মৃত্যুর সময়েও মা তাকে দেখতে চাননি। মা, সোনামণি মা!
চোখের সামনে থেকে কুয়াশা যেন ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। অন্ধকার ভেদ করে একফালি সোনালি রোদ নিঃসঙ্গ হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টি করল। মনে পড়ল ছোট্ট দুটি ভাই আর্নেস্ট আর উইলিয়মের কথা। দাদাকে তারা কত ভালোবাসে। দাদা তাদের বড় বৈজ্ঞানিক–এই গর্বে তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটে। আর এলিজাবেথ! মা’র পালিতা কন্যা। একটার পর আর একটা ছোট ছোট ঘটনা তার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো এসে সরে যেতে লাগল।
আমাদের এই দুঃখ ও বিপদের দিনে প্রভূত সাহায্য করেছে তোমার বন্ধু ক্লেরভাল। তোমার মা’র সেবা-শুশ্রষা থেকে শুরু করে শেষ কাজ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন সে করেছে। তার কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। আজও সে সমানে আমাদের দেখাশোনা করে।