ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর দেখলেন, তাঁর বন্ধু উত্তেজনায় শ্রান্তিতে ও ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ নিয়ে টলতে টলতে ছুটে চলেছেন সেই বিকটাকার দানবের পিছনে। কতবার তার দেই অবসন্ন তুহিন বরফের উপর পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি স্থির হতে পারছেন না। পরক্ষণেই উঠে ছুটে যাচ্ছেন গলা বরফের উপর দানবের পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে।
ক্লেরভাল একবার গুলি ছুঁড়ে বন্ধুকে জানাতে চাইলেন যে তিনি তাঁর সাহায্যে এসেছেন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শুনতে পারলেন কি না বোঝা গেল না। শীতে ও ভয়ে অবসন্ন হাত থেকে কখন তাঁর বন্দুক পড়ে গেছে, কাঁটাগাছে বিধে জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে তবু দানবটিকে একবার শিক্ষা দেওয়ার নেশায় ছুটে চলেছেন তিনি।
কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনো জ্ঞানও নেই–শুধু সেই পিশাচটিকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছেন তিনি। বরফ-ঢাকা বিরাট পাহাড় অতি সহজে পার হয়ে যাচ্ছে দানবটি, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনও মরিয়ার মতো সেই দুরধিগম্য পাহাড় সমানতালে ডিঙিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সমস্ত দেহে যেন এক অমানুষিক শক্তি ভর করেছে। সুস্থ দেহে ও মনে যে ঝুঁকি নেওয়া যায় না, যে পাথর লাফিয়ে যাওয়া যায় না, যে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায় না–সেই দৈত্যকে ধরার জন্য তা সবই অবলীলাক্রমে করে যাচ্ছেন। পুলিশের দলবল নিয়ে ক্লেভাল তার বন্ধুর কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। এত তাড়াতাড়ি তাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
হঠাৎ ক্লেরভাল সভয়ে শিউরে উঠলেন। একজায়গায় বরফ গলে জল হয়ে গেছে। ছোট ছোট বরফের টুকরোয় সেই জলের স্রোত আরো ভীষণ বেড়ে গেছে। দানবটি অতি সহজেই সেই জলাটি পার হয়ে চলে গেল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উন্মাদের মতো সেই জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ আর কিছু দেখা গেল না। একটু পরে ক্লেরভাল দেখলেন যে, দানবটি তাঁকে ধরে তুলে নিজের কাছে নিয়ে এল।
ক্লেরভাল এবার তাঁর দলবল নিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে খানিকটা ঘুরে সেইখানে এলেন। ভীত-বিহ্বল হয়ে দেখেন তার মৃত বন্ধু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের নিঃসাড় দেহ একটা পাথরের উপর শোয়ানো আর এক বিরাট দৈত্য ঝুঁকে পড়ে ছলছল কণ্ঠে বলছে : হে আমার স্রষ্টা, আমি এ কী করলাম! আমিই তোমাকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাইনি, তবু তুমি আমারই জন্য মারা গেলে। আমি শুধু তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছি যেমন তুমি আমাকে শাস্তি দিয়েছ। তবু তোমার–আমার স্রষ্টার– হত্যাকারী আমি, আমার এ পাপের স্থান নেই। হে ভগবান, তোমার মৃত্যুতেই আমার সমস্ত অভিমানের অবসান হল। তোমাকে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের অনুভূতি দিতে পেরেছি, আমার আর বাঁচার প্রয়োজন নেই। আমিও শিগগিরই তোমার সঙ্গে মিলিত হব। সারাজীবন আমি একাকী সঙ্গীহীন ছিলাম, মৃত্যুও হবে সঙ্গীহীন। কোনো এক উত্তরমেরু দেশে নিজের চিতা নিজে প্রস্তুত করে আমার এই ঘৃণিত জীবন আহুতি দেব। আর-একবার এই সুন্দর পৃথিবীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শেষ দেখা দিয়ে যাব আমার জন্মস্থান, তোমার অক্লান্ত কর্মের পীঠস্থানকে, তারপর সব শেষ ! বিদায় স্রষ্টা–বিদায়।
দানবটি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়েই দেখল বিস্মিত ক্লেরভালকে এবং সঙ্গে সঙ্গে একলাফে অনেকদূর চলে গেল। ক্লেরভালও তাঁর বন্দুক তুলে গুলি ছুড়লেন। হয়তো সে আহত হল, এক আর্তনাদও শোনা গেল–আঁ আঁ আঁ….
স্রষ্টার শোকে হয়তো সে আবার তার ভাষা হারিয়েছে, আবার পেয়েছে সে তার জনুক্ষণের ভাষা।
পুলিশবাহিনী তাদের কুকুর নিয়ে এগিয়ে চলল। ক্লেরভাল বললেন–আমরা ল্যাবরেটরির দিকে যাব। দানবটি নিশ্চয় সেখানেই যাবে। আমি শুনেছি তার কথা।
কিছুক্ষণ পর আর সেই দৈত্যটিকে দেখা গেল না। সকলে অবাক হয়ে গেল; কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল কাছের একটি পাহাড় থেকে সে নেমেই দুটো কুকুরকে নিয়ে অন্তর্ধান হল। ব্যাপারটা এত আকস্মিক ঘটল যে তারা কিছুই করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে কুকুরদুটোর মৃত্যু-আর্তনাদ শোনা গেল।
কিন্তু পরাজয় স্বীকার করলে চলবে না। পুলিশবাহিনী তার পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে, সবার আগে ক্লেরভাল। কুকুরগুলো চারদিক থেকে চিৎকার করতে করতে তাড়া করেছে। একবার সেই দৈত্যকে দেখা যায়, আবার সে হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ–একটা আর্তনাদ। আবার হয়তো দু-একটি কুকুরের মৃত্যু-আর্তনাদ শোনা যায়। কোথাও-বা দু-একটি পুলিশের মৃতদেহও গড়িয়ে পড়ে। তবু থামা নয়, পুলিশবাহিনী এই হত্যাকারীকে ধরবার অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে।
এক ঝলক কুয়াশায় সমস্ত পৃথিবী ঢাকা পড়ে গেল। সামনে-পেছনে কিছুই দেখা যায় না। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল সেই শয়তান।
একটু পরে কুয়াশা কেটে গেলে তাকে দেখা গেল আর একটি উঁচু পাহাড় বেয়ে সে উঠছে; উঠছে সে উধ্বমুখী পাইন, চেরি, দেওদারের সারি ছাড়িয়ে তুষারাবৃত সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে উঁচুতে–আরো উঁচুতে, আর পিছনের নৃশংস অনুসরণকারীদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচোচ্ছে। এই হয়েছে মানুষের বুদ্ধি, মানুষের সাহস। তাকে ধরবার জন্য মানুষের কী আপ্রাণ চেষ্টা! কত লোক, কত কুকুর, কত বন্দুক, কত গুলি! তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। এইভাবে এত লোকের সঙ্গে সে একা যুদ্ধ করবে কী করে? এক-একজন আসুক–আপত্তি নেই। সে দেখিয়ে দেবে মানুষের চেয়েও সে শ্রেষ্ঠতর–মানুষের চেয়েও তার স্থান উচ্চে।