তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রতিদিন বন্দুক হাতে বের হন সেই দানবটির সন্ধানে। এতদিন যা পারেননি এবার তা-ই করবেন। দেখা পেলেই আর কথা নয়…অব্যর্থ সন্ধানে দানবটিকে ভূপাতিত করবেন।
সে নিশ্চয়ই তাঁর ওপর লক্ষ রাখে। কারণ তিনি যেদিন যেদিকে দানবটির খোঁজে বের হন, ঠিক তার বিপরীত দিকে সেদিন হত্যাকাণ্ড চলে।
এলিজাবেথকে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন–আমি জানি কে এই হত্যা করছে।
এলিজাবেথের মুখ ভয়ে পাংশু হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল–কে?
সেকথা আপাতত গোপন থাক। তবে সে মানুষ নয়।–বললেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
এলিজাবেথ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল–তুমি অসুস্থ। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।
এদিকে বিবাহের দিন ঘনিয়ে আসে; তবু তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। এখন অবশ্য আর হত্যাকাহিনী শোনা যাচ্ছে না। তবে কি সে এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে? সে কি সত্যিই বুঝেছে যে প্রতিহিংসা দিয়ে শান্তি আসে না।
বিবাহের দিন হঠাৎ তার মনে হল–আজই তো তার দর্শন দেবার কথা। তিনি রিভলভার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।
ক্লেরভালের সঙ্গে তাঁর গল্প করতে ভালো লাগছিল না। মাঝে মাঝে চমকিয়ে ওঠেন। ক্লেভাল জিজ্ঞাসা করেন–তোমার কী হয়েছে বলো তো?
কিছুই হয়নি–উত্তর করেন তিনি।
.
বিবাহ নির্বিঘ্নে শেষ হল। শেষ হল সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। বিদায় জানিয়ে
অতিথিরা চলে গেলেন একে একে। এলিজাবেথ চলে গেল তার নিজের ঘরে।
ক্লেরভালের সঙ্গে নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ তার কানে ভেসে এল। পরমুহূর্তে কয়েকজনের ছুটে আসার শব্দ, কতগুলো আর্তনাদ–এই বিশৃঙ্খলা! একমুহূর্তের জন্য তিনি বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন, তারপর ক্লেরভালের হাত ধরে ছুটে গেলেন বাড়ির ভেতরে।
সিঁড়ির ওপরে পড়ে আছে তার বাবার মৃতদেহ। গলাটি কে যেন মুচড়িয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। এলিজাবেথের ঘরে গিয়ে দেখেন এলিজাবেথের সুন্দর ফুলের মতো দেই অসাড় হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে।
আর দাঁড়াতে পারলেন না, ঐ দৃশ্য দেখতেও ইচ্ছা করে না। টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর্নেস্টের ঘরে গিয়ে দেখলেন ঠিক সেই অবস্থা। আর্নেস্টের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে তার বিছানায়।
সেখানেই বসে পড়লেন তিনি।
জানলার পাশ থেকে একটি অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল–তোমার সঙ্গীও এখন আর কেউ রইল না। এবারে তুমি বুঝবে নিঃসঙ্গ জীবন কেমন আনন্দের! প্রভু, এবার তুমি আর আমি একা!
উঠতে চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। তাঁর জ্ঞানহীন দেহ সেখানেই লুটিয়ে পড়ল।
.
১০. সব শেষ
অত্যন্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তির মধ্যে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। মনে হল কী যেন হারিয়েছে, আর কী যেন তিনি ভুলে গেছেন। একটু ভাবতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।
হঠাৎ শুনলেন কে যেন বলছে–হে আমার প্রভু, এবারে তুমি আর আমি একা। তোমার জীবন দিয়ে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের সুখ অনুভব করো।
তারপর শার্সিতে দেখা গেল একটি কদাকার মুখ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল সমস্ত কথা। ওই দানবটি আজ রাত্রে আর একটু আগে তাঁদের বাড়িতে এক প্রলয়কাও বাধিয়েছে। নিমেষের মধ্যে হত্যা করেছে এলিজাবেথ, আর্নেন্ট আর তার বাবাকে–
তিনি কম্পিত হাতে বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি ছুড়লেন।
ততক্ষণে সেই দানবটি অশরীরী ছায়ার মতো সাদা বরফের পাহাড়ের মধ্যে মিশে গেছে, কিন্তু দূর থেকে তার অট্টহাসি তখনো শোনা যাচ্ছিল।
বন্দুকের শব্দে ছুটে এলেন ক্লেরভাল। বললেন–কী হয়েছে বন্ধু?
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–বন্ধু, আজ আমি তোমাকে সব কথা বলব। কিন্তু বলো–অবিশ্বাস করবে না?
ক্লেরভাল বললেন–অবিশ্বাস করব তোমাকে!
তিনি বললেন–হ্যাঁ বন্ধু। আমার কাহিনী শুনলে তুমি আমাকে পাগল ভাববে। আর বলবে, এতগুলো শোকে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ক্লেরভাল ভার বেদনার্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন — না বন্ধু, তোমাকে অবিশ্বাস করব না।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তখন বললেন–তবে শোনো। আমার গবেষণার বিষয় ছিল সাধারণ লোকের কাছে অবিশ্বাস্য, এমনকি বৈজ্ঞানিকদের কাছেও অসম্ভব কল্পনার মতো। আমার গবেষণার বিষয় ছিল মৃতদেহে প্রাণ দান করা, তাকে অতিমানুষে রূপায়িত করা। এই নিয়ে বছরের পর বছর আমি পরীক্ষা করে চলেছি। একদিন আমার সাধনা সফল হল। মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলাম।
মানুষ তৈরি করলাম বটে, কিন্তু প্রাণ পেয়ে সে হল দানব। একদিন সে ডক্টর নীল আর বেয়ারাকে হত্যা করে ওখান থেকে পালাল। তারপর যেখানে যত পৈশাচিক খুন হয়েছে, সব ওই দৈত্যের কাজ। উইলিয়মকে হত্যা করেছে ও, আর কাল এসে আমাদের বাড়ির সকলকে খুন করে গেছে। আমি আর একটু আগেও তাকে দেখেছি। তাই বলছি বন্ধু, জনকতক লোক জোগাড় করো, সশস্ত্র হয়ে চলো–আমরা ওকে হত্যা করব। নয়তো পৃথিবীতে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না।
ক্লেরভাল বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তারা দুজনেই দেখলেন জানলার কাছে এক কদাকার মুখ। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নিয়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ওইদিকে ছুটে গেলেন।
বন্ধুকে ওভাবে অনিশ্চিত আতঙ্কের মধ্যে ছুটে যেতে দেখে ক্লেরভালও তার কর্তব্য স্থির করে নিলেন। আধঘণ্টার মধ্যে থানা থেকে নিলেন কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ এবং কয়েকটি কুকুর। তারপর ছুটে চললেন বন্ধুর উদ্দেশে।