তখন একজন বললেন–ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, এবারে আমরা তবে আমাদের কাজ আরম্ভ করি। এর পরে বড় বেশি বেলা হয়ে যাবে, পথে লোক চলাচল শুরু হয়ে যাবে। তখন ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–হ্যাঁ, এখনই হাত চালানো উচিত।
ভরা দুজনে শাবল কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে তারা এসে দাঁড়ালেন।
এক অজানা আতঙ্ক, এক গা-ছমছম ভয়, শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে তুষার-শীতল হিমপ্রবাহ–তাদের সমস্ত শরীরকে যেন অসাড় করে ফেলছিল। এই গোপন শব-সন্ধান বা শব-শিকার মানুষের চোখে কত ঘৃণ্য, কত পাপ! বিবেক বাধা দেয়, কিন্তু তারা নিরুপায়! বিজ্ঞান-সাধনার দুরন্ত আহ্বান তাঁদের এই অসামাজিক কাজে বাধ্য করেছে।
ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ, উঁচু-করা মাটির ঢিপির উপর একটা ক্রশচিহ্ন, কিছু ফুল–তার সুরভি সে জায়গাকে ঘিরে রয়েছে। আর চারদিক নির্জন, তখনো দু-একটা তারা আকাশের শেষ কোণে বসে অবাক হয়ে পৃথিবীর একপ্রান্তে তাদের দিকে চঞ্চল-চোখে তাকিয়ে রয়েছে; বোবা নীল আকাশ যেন ব্যথায় ম্লান হয়ে গেছে, আর সেই বিস্তীর্ণ নির্জন সমাধিক্ষেত্র অসহ-বিস্ময়ে এই দুটি অবাঞ্ছিত মানুষের সমস্ত কাজ লক্ষ করে চলেছে যেন যখন-তখন অট্টহাসি হেসে উঠতে পারে। দু-একটা গাছের শাখা কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে, তার শব্দও সেখানে অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই নিরাত্ম্য অশরীরীদের বাসস্থানের রহস্যময় আবহাওয়াতে দুজনেই একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন।
ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–নীল, এবার হাত চালান। কিন্তু খুব সাবধান! মৃতদেহের যেন কোনো অনিষ্ট না হয়। কোথাও যেন তার আঘাত না লাগে।
তারা দুজনে খুব তাড়াতাড়ি গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। উত্তেজনায় সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছিল, কপালে জমে উঠছিল ঘাম। চোখের পাতা পড়ছে না, শুধু হাত চালাও, হাত চালাও। আর সময় নেই।
পাখিরা দু-একটি যেন কোথায় ডেকে উঠল। তবে কি আজ আর এই মৃতদেহের উদ্ধারের কোনো আশা নেই। তবে কি তাদের এই এতদিনের সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে? তবে কি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষয় কেউ জানতে পারবে না– দেখতে পারবে না। মানুষ যে মানুষের চেয়েও বড়, তার শক্তির যে সীমা নেই– এ প্রমাণ কি জগৎ কোনোদিন পাবে না?
নীল বললেন–অসম্ভব, এতখানি খোঁড়া অসম্ভব। এরা কত খুঁড়ে কবর দিয়েছে!
ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–ওদের দোষ কোথায়? এই সমাধিক্ষেত্র থেকে কিছুদিন আগেই আরো কয়েকটা মৃতদেহ চুরি যাওয়াতেই তাদের এই সাবধানতা! সেই শব-শিকারি যে কে–আমার আর আপনার চেয়ে কে আর তাদের ভালো করে জানে?
কিন্তু ঠক্ করে শাবল যেন কিসের উপর লাগল। তারা দুজনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। তবে কি শবাধারে শাবলটা লেগে গেছে। তারা দুজন পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন; মুখে বিজয়ের হাসি, চোখে সাফল্যের জ্যোতি, বুকে জয়গৌরবের উৎকণ্ঠা।
কিন্তু সেটা প্রকাণ্ড এক পাথর। হতাশায় মন ভেঙে গেল। এতক্ষণ অমানুষিক পরিশ্রমের ফল কি সামান্য এক পাথরের জন্য। তাদের আর গর্ত খুঁড়বার সামর্থ্য রইল না, তারা দুজনেই গম্ভীর হতাশায় বসে পড়লেন। এই শীতের মাঝে রাত্রের নিদ্রাত্যাগ করে মিথ্যা এ পণ্ডশ্রম!
কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। তারা বৈজ্ঞানিক, তাদের পরীক্ষার মাঝে কত বাধা এসেছে–তবু তো তারা কখনো ম্রিয়মাণ হননি। কখনো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েননি। আজ এতদূর গর্ত খুঁড়ে মাত্র অল্প একটুর জন্য তাঁদের আজীবন সাধনা সফল হবে না? জগৎ কি জানবে না যে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কী বিস্ময়কর অধ্যায় পৃথিবীর বুকে এনে দিলেন!
.
তারা দুজনে আবার নতুন উদ্যমে গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। পাথর গেল গুড়ো হয়ে, মাটি চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আর দেরি নেই, আর দেরি নেই…
শবাধারটা তাঁরা দুজনে টেনে তুললেন। এখনো নতুন রয়েছে, কোথাও আঁচড় লাগেনি।
কিন্তু ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে। এই সময়ে প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে শব চুরি করে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। যখন-তখন ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তারপর কানাকানি, কৈফিয়ত, হাঙ্গামা–
নীল বললেন–আর গর্ত বন্ধ করতে হবে না। দেরি হয়ে যাবে, কেউ দেখেও ফেলতে পারে। এখন পালানোর চেষ্টা করা দরকার। একবার গিয়ে ল্যাবরেটরিতে
উঠতে পারলে হয়! তারপর
ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–কিন্তু যাব কী করে? সকাল হয়ে এল যে! কুয়াশা এখনো কাটেনি বটে, কিন্তু লোকের চোখে বামালসুদ্ধ ধরা পড়ে যাব।
নীল বললেন–এক উপায় আছে। অনেক ঘুরে যেতে হবে। উঁচু পাহাড়টার উপর দিয়ে ঘুরে পিছন দিক দিয়ে ল্যাবরেটরিতে গেলে কেউ দেখতে পাবে না।
ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন-এ ছাড়া আর উপায় কী! তাই চলুন।
.
তারা দুজনে শবাধারটিকে কাঁধে করে এগোতে লাগলেন। পাঁচিলের কাছে এসে তার উপর শবাধারটাকে তুলে দিয়ে তারা দাঁড়ালেন। কিন্তু শবাধারটি পাচিলের উপর ঠিক হয়ে থাকতে পারল না। এপাশ-ওপাশ নড়তে লাগল। তারা শবাধারটিকে ভালো করে ধরার আগেই সেটা ওদিকে উলটে পড়ে গেল, দুজনে চিৎকার করে উঠেই পাঁচিল টপকিয়ে ওপাশে লাফিয়ে পড়লেন। উঁচু থেকে পড়ে শবাধারের দু-এক জায়গায় চোট লেগেছে।
আবার শবাধারটিকে তারা তুলে নিলেন। কে জানে ভিতরে মৃতদেহের কী হয়েছে কোনো ক্ষতি হয়েছে কি-না! মনে একটা খটকা লেগে রইল, অস্বস্তিকর এক সংশয়। তাদের আর উঁচু পাহাড়টার উপর দিয়ে যাওয়ার সাহস হল না।