তিনি প্রশ্ন করলেন–তোকে বিশ্বাস কী? যদি দলে ভারী হয়ে তোরা আরো বেশি অত্যাচার করিস? দৈত্যটি বলল–কেন অবিশ্বাস করছ প্রভু বলেছি তো আমি হত্যা করেছি সঙ্গী পাইনি বলে–ভালোবাসা পাইনি বলে। যদি সঙ্গী পাই, তবে তোমাদের এই লোকালয় ত্যাগ করে আমরা অনেক দূরে চলে যাব–আর আসব না এখানে মানুষের ঘৃণা কুড়োতে।
তিনি বললেন–তোকে সৃষ্টি করেই আমি জগতের সবচেয়ে বেশি অপকার করেছি। আর আমার পাপ বাড়াতে পারি না। আমি আর কিছু করতে পারব না।
দৈত্যটি বলল–এই তোমার শেষ কথা! বেশ, তবে তোমাকেও শান্তিতে থাকতে দেব না। আগে তোমার সমস্ত আত্মীয়, তারপর একে একে আর্নেস্ট, তোমার বাবা, এলিজাবেথ, বন্ধু ক্লেরভাল–সকলকে হত্যা করব। তুমি দেখবে এক-একদিন কেমন করে এক-একজন তোমার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। তখন তুমি খুব শান্তিতে থাকবে। নিঃসঙ্গ জীবন যখন তোমাকে পাগল করে তুলবে, যখন তোমার জীবন আমার জীবনের মতো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তখন বুঝবে নিঃসঙ্গ জীবনে কত আনন্দ, তখন তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমার সঙ্গী হবে।
বড় ভয় হল তার। নিজের প্রাণের ভয়ে নয়–তার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের জীবন-সংশয়ে ভীত হয়ে তিনি আর একটি জীব সৃষ্টি করতে সম্মত হলেন। বললেন–বেশ, আমি এটি তৈরি করে দেব। কিন্তু তোর প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে। তোর সঙ্গী পেলেই তোরা লোকালয় ছেড়ে দূরদেশে চলে যাবি। আর কোনোদিন এদেশে ফিরে আসবি না। আর নরহত্যাও করতে পারবি না।
দৈত্যটি বলল–তাই হবে প্রভু।
তিনি বললেন–বেশ! তবে কালই আমি আবার ল্যাবরেটরিতে ফিরে যাব।
বাড়িতে গিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জানালেন যে পরদিনই তাঁকে ফিরতে হবে ল্যাবরেটরিতে বিশেষ কাজে। মাত্র কয়েকদিন তারপর ফিরে এসে তিনি এলিজাবেথকে বিবাহ করবেন।
.
তারপর আবার সেই আগের মতো পাহাড়প্রমাণ অস্থি সগ্রহ, আর জোড়াতালি দিয়ে মনুষ্যাকৃতি গড়া। কিন্তু এবার আর আগেকার মতো উৎসাহ নেই। সব সময়ে মনে ভয় হয়; ভয় কেন–তিনি স্থিরই জানেন এবারেও যাকে তিনি সৃষ্টি করবেন, সে মানুষ হবে না। সে হবে ঠিক আগেকার মতোই এক অতি কুৎসিত ও কদাকার দানব।
বেশ জানেন তাঁর ওপর লক্ষ রেখেছে সেই দৈত্যটা। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই তার অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেন। মাঝে মাঝে শার্সিতে তার ছায়া দেখতে পান, আর তার সমস্ত অঙ্গ বিকল হয়ে আসে। শুধু প্রাণের ভয়েই তার আদেশ পালন করছেন তিনি! তাঁরই সৃষ্টির ক্রীড়নক আজ তিনি! ভাগ্যের এতদূর পরিহাস!
মাঝে মাঝে ভাবেন, এ কী সর্বনাশ করতে চলেছেন তিনি। একটি দানবকে নিয়েই এত অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে, আর একটি হলে তো সমস্ত পৃথিবী ছারখার হয়ে যাবে। না–আর তিনি এ-কাজ করতে পারবেন না।
আবার মাঝে মাঝে মনে পড়ে সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বাবা, আর্নেস্ট, ক্লেরভাল আর এলিজাবেথের মুখ। দৈত্যটি শাসিয়ে গেছে যে, তার সঙ্গী না করে দিলে আর কারুর নিস্তার নেই। একদিকে এত আত্মীয়, প্রিয়জন আর একদিকে আর এক দানব সৃষ্টি।
দেখেন, যতই নতুন দৈত্যটির রূপ-সৃষ্টি অগ্রসর হচ্ছে ততই সেই দৈত্যটির চোখমুখ ঝলমল করছে, সারা দেহে যেন আনন্দ উথলে পড়ছে। তবে কি দৈত্যটি বিশ্বাসঘাতকতা করবে? একটি সঙ্গী পেলে এতদিনের সমস্ত ঘৃণার প্রতিহিংসা নেবে মানুষের ওপর?
কাজে বাধা পড়ে। আর কাজ করতে তার মন বসে না। তিনি কী করবেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তারপর হঠাৎ মনে হল দানবের কথার কোনো দাম নেই। জগতের যে সর্বনাশ তিনি করেছেন তা-ই পূর্ণ করতে পারবেন না কোনোদিন–মিছে আর কেন ধ্বংস ডেকে আনা?
মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। আর তিনি ভাবতে পারেন না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেই আধা-গড়া মনুষ্যমূর্তিটির দিকে, তারপর তাকে আঘাতের পর আঘাতে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে ফেললেন। শব্দ শুনে দৌড়ে এল দৈত্যটি। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই ভাঙা অস্থিপঞ্জরের দিকে! চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল টলটল করে উঠল।
করুণ আর্তনাদে ভেঙে পড়ে বলল–ভেঙে ফেললে! তবে তুমি কি আমাকে একটি সঙ্গী তৈরি করে দেবে না!
তিনি চিৎকার করে উঠলেন–না, না দেব না। তোকে সৃষ্টি করেই আমি জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ কুড়িয়েছি, আর নয়। এবার দূর হয়।
চোখদুটো তার জ্বলে উঠল। বলল-দূর হব? বেশ দূরই হব! এতদিনেও যে তোমার শিক্ষা হয়নি তা বেশ বুঝতে পারছি। ধ্বংসের কথা বলছিলে, অভিশাপের কথা বলছিলে? এতদিন তো তুমি ধ্বংস কাকে বলে দেখতে পাওনি। এইবারে তাই দেখবে। দেখব সুখী হও কিনা। যাবার আগে বলে যাচ্ছি যে কাল থেকে মানুষের কান্নায় সারা পৃথিবী ভরে উঠবে। আর তার জন্য একমাত্র দায়ী তুমি! হে ভগবান, তুমি–তুমি–
কিছুদূর চলে গেল সে। সেখান থেকে চিৎকার করে বলল–আমাকে নিঃসঙ্গ করে তুমি সুখে ঘর বাঁধবে? বেশ! তোমার বিয়ের রাতে আবার আমার দেখা পাবে। প্রস্তুত থেকো, প্রভু, সেই রাতের জন্য প্রস্তুত থেকো।
.
অত্যন্ত অসুস্থ দেহ মন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। সকলে সশঙ্ক হয়ে উঠল। এ কী হয়েছে তার চেহারার? কারো সঙ্গে আলাপ করতেও তাঁর ভালো লাগে না।
কিন্তু দিন কেটে যায়। আর প্রতিদিনই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের ভৌতিক মৃত্যুকাহিনীর খবর পান। সশস্ত্র পুলিশবাহিনী খুঁজে বেড়াচ্ছে আসামিদের। তিনিই শুধু জানেন এই হত্যাকারী কে। অথচ তাদের এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন না; কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না।