তুমি কি জানো না যে, একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কতদূর অসহ্য। এই জীবন এখন এত দুর্বহ হয়ে উঠেছে যে, এক এক সময় ভাবি আত্মহত্যা করে সমস্ত জ্বালা জুড়োই। কিন্তু পারি কই? চোখে পড়ে এই পৃথিবীর আলো-বাতাস, গাছপালা, আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য! আর অনুভব করি আমার এই কুৎসিত দেহের মধ্যেকার সুন্দর প্রাণটিকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি।
তাই আর আমার পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব হল না! ভাবলাম–এই পৃথিবীর ওপর, জাগতিক সমস্ত সৌন্দর্যের ওপর প্রতিশোধ নেব। প্রতিশোধের জন্য আমি বদ্ধপরিকর হলাম। বললাম–হে স্রষ্টা, তুমি আমাকে কুরূপ দিয়েছ, তুমি আমাকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছ, আমিও লোকের জীবন সেইরকম নিঃসঙ্গ আর যন্ত্রণাময় করে তুলব। আমি তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলকে মরণের পরপারে পাঠিয়ে তাদের সমস্ত সুখ-আহ্লাদ চিরকালের জন্য দূর করে দেব। তাদের ঘৃণা আর আমার হত্যা–এই দুই একসঙ্গে সমান্তরালভাবে চলবে।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমি অনেক জায়গা ঘুরেছি। কত লোক যে হত্যা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু দেখছি প্রতিহিংসায় মনে শান্তি পাই না। তুমি আমার ভগবান, আমার জীবনদাতা, আমার প্রভু, আমার স্রষ্টা–তাই তোমার কাছে আমি ফিরে এসেছি। তুমি আমার দিকে মুখ তুলে চাও। তোমার সৃষ্টির ওপর এই অসঙ্গত ব্যবহার তোমার শোভা পায় না। মানুষের সমস্ত অন্যায় যখন ভগবান ক্ষমা করেন, তখন তুমি আমার স্রষ্টা হয়ে কেন আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করবে না? যখন জীবনই দিলে সুখ এনে দাও, শান্তি এনে দাও।
তোমার ভাইকে হত্যা করেছি বলে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। কিন্তু সে দোষ কি আমার তোমাকে দুঃখ দিয়ে আমিও কি দুঃখ পাইনি। আমি তো তাকে মারতে চাইনি, আমি তাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সে ছোট ছেলে, হয়তো সে আমায় ঘৃণা করবে না–হয়তো আমাকে তার সঙ্গী করে নেবে। আমার স্রষ্টার ভাই সে, কত আশা করে তার কাছে গেছিলাম, কিন্তু সে-ও ঠিক তোমার মতো ভয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। সে জোর করে আমার কাছে থেকে চলে যেতে চাইল।
তখন আমার ভয়ানক রাগ হল। ভাবলাম, যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আমার এই দুর্দশা এই দুরদুষ্টের জন্য দায়ী, তারও কোনো সঙ্গী রাখব না। তাই তোমার ভাইকে। হত্যা করলাম। আর একটি স্ত্রীলোক–তোমাদের কেউ হবে–সে-ও একদিন আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তাকে শাস্তি দেব ঠিক করেছিলাম। তাই সে যখন নগরের বাইরে একটি ঘরে একা নিদ্রামগ্ন তখন তার পোশাকের মধ্যে রেখেছিলাম তোমার মৃত ভাইয়ের সোনার লকেট। পুলিশ তাকে হত্যাকারী বলে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিয়েছে।
শোনো আমার কথা…
কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর শুনতে পারলেন না। রাগে, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। এই পিশাচটি শুধু তার ভাইকে হত্যা করেই তৃপ্ত হয়নি, হত্যার অপরাধ তুলে দিয়েছে উইলিয়মের পরিচারিকা জাস্টিনের ঘাড়ে। এতদিন তার যা শুধু মনের ধারণা ছিল, আজ সেকথা সত্য প্রমাণিত হল। যদি একথা সে অস্বীকার করত, তবে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করলেও তবু তার সান্ত্বনা একটু থাকত–হয়তো দৈত্যটি সত্যকথা বলছে। তবে জাস্টিনের মৃত্যুর জন্য তিনিও দায়ী হতেন না। কিন্তু আজ তিনি সত্য সত্যই নিরপরাধ জাস্টিনের হত্যাকারী।
আর সহ্য করতে পারলেন না, চিৎকার করে উঠলেন তিনি–না–না, তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার সম্মুখ থেকে তুই দূর হয়ে যা।
পিছন ফিরে তিনি পা বাড়ালেন।
পিছন থেকে আকুতি শোনা গেল–শোনো, আমার সব কথা শুনে যাও…
কিন্তু তিনি আর শুনলেন না। এগিয়ে চললেন।
পিছন থেকে ছলছল কণ্ঠে কয়েকটি কথা শোনা গেল।–চলে গেলে। বেশ, তবু আমি আশা ছাড়ব না। তুমি যেখানে যাবে সেখানে তোমার সঙ্গে আবার দেখা করব। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ; আমি জানি তুমি আমাকে দুঃখ দিতে পারবে না–আমার কথা ফেলতে পারবে না।
৯-১০. পৈশাচিক প্রতিহিংসা
দানবের কথায় তার যেমন ভয়ও হল, মানসিক অশান্তিও তত বেড়ে গেল। এইরকম মানসিক অবস্থায় বেড়িয়ে ফিরতেও ভালো লাগে না। তাই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আবার জেনেভায় ফিরে এলেন। এলিজাবেথ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু মনে তার শান্তি নেই।
কিছুই ভালো লাগছে না তার। শুধু থেকে-থেকে মনে হয় সেই দানবের কথা। সে আবার দেখা করবে বলেছে। ওই দানবটির হাত থেকে পরিত্রাণের কী উপায় থাকতে পারে তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।
একদিন সন্ধ্যার পর এলিজাবেথের সঙ্গে বেড়িয়ে ফিরছেন তিনি, মনে হল পিছন পিছন কে যেন আসছে! চমকে পিছন ফিরলেন, দূর অন্ধকারে একটা কালো বিদ্যুৎ যেন চকিতে মিলিয়ে গেল। তার ভয় হল। এই বীভৎস দানবটির অস্তিত্বের কথা তিনি এলিজাবেথের কাছে গোপন রাখতে চাইলেন। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালালেন।
এইভাবে তার দিন কাটে। বুঝতে পারেন সেই দৈত্যটি তার কাছেই ঘুরছে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেউ থাকার জন্য সামনে আসছে না। একদিন তিনি একা একা ক্লেরভালের বাড়ি থেকে ফিরছেন, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন তাঁর হাত চেপে ধরল। এরকমই তিনি আশা করছিলেন, তবু চমকে উঠলেন। যা ভেবেছিলেন তাই; বললেন–আবার কী চাই তোর?
দৈত্যটি বলল–বলেছিলাম আবার আসব, তাই এসেছি। আজ আমার সব কথা ওনতে হবে।
একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। দৈত্যটি বলল–হে আমার প্রভু, আমি একজন সঙ্গী চাই, আমি চাই ভালোবাসা। আমি জানি কোনো মানুষই আমার সঙ্গে মিশবে না। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছে, আমার মতো আর একটি কদাকার কুৎসিত দানব সৃষ্টি করো–সে আমার সঙ্গী হবে। সে আমাকে ঘৃণা করবে না। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব। এই দুর্বহ জীবনে তবেই পাব শাস্তি।