মেয়েটি বলল–বেশ তো, ওই ফুলগুলো পেড়ে দাও। তারপর আমরা ফুলগুলো জলে ভাসাব।
মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এই মেয়েটি তবে আমায় ঘৃণা করে না। গাছের সমস্ত ফুল পেড়ে আমরা খেলতে শুরু করলাম। খেলতে খেলতে বেশ বেলা হয়ে এল। তখন আঁধার কেটে গিয়ে আলো ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মেয়েটির চোখ পড়ল আমার ওপর।
ভয়ে মেয়েটি পাংশু হয়ে গেল। চিৎকার করে পালাতে গেল। আমি তাকে ধরে বলতে গেলাম, খুকু, ভয় নেই, আমি ভূত নই। কিন্তু হয়তো–হয়তো তার গলায় একটু জোরে চাপ পড়েছিল, তাই মেয়েটি মারা গেল। বিশ্বাস করো, আমার ভগবান, বিশ্বাস করো ওই ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটিকে আমি মারতে চাইনি। ওই মেয়েটিই তো প্রথম ভালোবেসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, খেলা করেছে।
নিজের শক্তির ওপর এক অবিশ্বাস, এক নিদারুণ ভয় এসে গেল। মনে হল আমার অপরিসীম শক্তিই আমার সাধারণ মানুষের সঙ্গে সখ্য’র প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটুকু আমি বুঝতে পারলাম যে ইচ্ছা করলে আমার শক্তি দিয়ে মানুষের ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার স্থাপন করতে পারি; কিন্তু আমি তো তা চাই না। আমি চাই সকলের মতো সকলের সঙ্গে মিশতে–এই সুন্দর পৃথিবীর সবটুকু আনন্দ সকলের সঙ্গে সমানভাবে উপভোগ করতে।
তাই লোকালয় থেকে ছুটে পালিয়ে গেলাম। অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে বনের অন্ধকারে নিজের মুখ লুকোতে চাইলাম। কিন্তু হে আমার স্রষ্টা, তা পারলাম না। এই শীত, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ–সবকিছুর থেকে আত্মরক্ষার জন্য সকলের মতো আমারও তো আশ্রয় চাই। সকলের মতো আমারও তো আহার চাই।
ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামের দূর কোণে একটি পোড়োবাড়ি পেলাম। কাছেই বন। আমার বাড়ির সামনে শুধু ছোট একটি বাড়িতে এক বৃদ্ধ, আর স্বামী-স্ত্রী থাকে। আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতাম, আর গভীর রাত্রে বনে গিয়ে ফলমূল সংগ্রহ করে আনতাম।
.
আমার ঘরের জানলার ছিদ্র দিয়ে সামনের বাড়ির লোকদের দেখতে আমার বড় ভালো লাগত। দেখতাম, প্রতিদিন সকালে লোকটি হাতে একটি কুড়োল নিয়ে চলে যেত। সন্ধ্যাবেলায় সে একবোঝা কাঠ নিয়ে আসত। মেয়েটি তার খাবার এনে দিয়ে গল্প করত। দুপুরবেলায় মেয়েটি বৃদ্ধ লোকটিকে বাইরে রোদে বসিয়ে দিয়ে যেত, আবার বিকেলবেলায় তাকে ধরে ঘরে নিয়ে যেত। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যাবেলায় ছেলেটি আর মেয়েটি হাত-ধরাধরি করে বেড়াতে যেত। বৃদ্ধ লোকটিকে সব সময়েই দেখতাম একা বসে।
বৃদ্ধের জন্য আমার কষ্ট হত। বেশ বুঝতাম, তিনি ঠিক আমার মতোই নিঃসঙ্গ। প্রতিদিন স্থির করতাম, বাড়িতে কেউ যখন থাকবে না তখন আমি তার সঙ্গে গিয়ে আলাপ করব। কিন্তু সাহস হত না।
সেই ছেলেটির জন্যও মনে-মনে দুঃখ হত। সারাদিন সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সামান্য কাঠ সে মাত্র সংগ্রহ করে, অথচ আমার শক্তি দিয়ে সেই কাঠ আমি একটু সময়ে এনে দিতে পারি। তাই একদিন গভীর রাতে ছেলেটির কুড়োল নিয়ে কাঠ কেটে এনে তার বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে সেই ছেলেটি ও মেয়েটি বাড়ির সামনে স্তূপাকার কাঠ দেখে চমকে উঠেছিল। সেদিন আর সে বনে যায়নি, বাগানেই কাজ করেছিল। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে আমি তাদের কাঠ কেটে এনে দিতাম।
ধীরে ধীরে ওই পরিবারের ওপর আমার মমতা জন্মাতে লাগল। একদিন ছেলেটি ও মেয়েটি বাইরে চলে গেলে পর আমি সেই বৃদ্ধের কাছে গেলাম, তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বললাম। দেখলাম, তিনি চোখে দেখতে পান না। সেদিন আনন্দে আমার মন ভরে উঠল।
তারপর সেই ছেলেমেয়ের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন আমি সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতাম। বৃদ্ধও আমার সঙ্গে কথা বলে খুশি হতেন।
একদিন রাতে আমি তার সঙ্গে কথা বলছি, হঠাৎ সেই ছেলে ও মেয়েটি ফিরে এল। মেয়েটি আমাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল।
বৃদ্ধ বললেন–কী হয়েছে? ইনিই তো সেই ভদ্রলোক যার কথা তোমাদের কাছে বলেছি।
সেই লোকটি একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়ে আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে টেনে সরিয়ে নিল। তারপর লাঠি দিয়ে আমাকে আঘাত করল।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক চিৎকার করতে লাগলেন–তোরা কি পাগল হলি? এ ভদ্রলোককে তোরা মারধোর করছি কেন?
আমি জানতাম, সেই ভদ্রলোকটিকে আমি ইচ্ছা করলেই টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলতে পারি; কিন্তু মনে পড়ল বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা! আমাকে তিনি ‘ভদ্রলোক’ বলেছেন, ভদ্র ব্যবহার করাই আমার উচিত। কোনো কথা না বলে আমি সমস্ত অপমান সহ্য করে ফিরে এলাম। বুঝতে পারলাম না–কী আমার এমন অপরাধ যে লোকে আমাকে ঘৃণা করে!
তারপর একদিন এক নদীর জলে আমার পৈশাচিক মূর্তি দেখে নিজেই শিউরে উঠলাম। মনে হল কেউ তো আমাকে ভালোবাসবে না। এই কুৎসিত মুখ, এই কুৎসিত দেহ–কেউ সহ্য করতে পারবে না। আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। এই জীবনকে আমি বড় ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তাই বাঁচতে চাই, আমি ভালোবাসা চাই।
কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার ভীষণ মূর্তি দেখে কেউ ভালোবাসে না, কেউ কাছে আসতে চায় না–দূরে সরে যায়। আমি একলা, একেবারে নিঃসঙ্গ। তুমি আমার প্রাণ দিয়েছ, কিন্তু রূপ দিলে না কেন? কেন আমায় এত কুৎসিত করে গড়ে তুললে? আর তোমার সৃষ্টিকে কেন তুমি ভালোবাসতে পারলে না?
প্রাণ দিলে, রূপ দিলে না। প্রাণ দিলে, সঙ্গী দিলে না। এই বিরাট পৃথিবীতে সকলে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করছে–আমি শুধু একা আমার দুঃখের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি কি বুঝতে পারো না যে, তুমিই তোমার সৃষ্টির ওপর মর্মান্তিক অবিচার করেছ।