.
৮. দৈত্যের কাহিনী
দৈত্যটি বলতে লাগল :
আমার জন্মকাহিনী তুমি তো আমার চেয়েও ভালো জানেনা, আমারই স্পষ্ট মনে নেই। ইচ্ছা হয়, কেন তুমি আমাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে আনলে তা জানতে। মৃত্যুর নিরন্ধ্র অন্ধকারে আমি নিমগ্ন ছিলাম। পৃথিবীর এত রূপ, এত সৌন্দর্য, এত আলো, এত হাসি–সব আমার চোখ থেকে চিরকালের জন্য দূর হয়ে গেছিল, কিন্তু হে আমার স্রষ্টা, হে আমার পিতা–তুমি আবার আমাকে নতুন করে জীবন দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে নিয়ে এলে। আমার এ আনন্দের কথা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছি না। হে স্রষ্টা, তাই তোমাকে আমি আমার প্রাণের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। হে আমার দেবতা, আমার প্রণাম গ্রহণ করো।
হঠাৎ যেন লক্ষ লক্ষ বছরের ঘুম থেকে আমি জেগে উঠলাম। আলো দেখলাম। এই সুন্দর পৃথিবীকে যতই আমি দেখতে লাগলাম ততই আমার ভালো লাগল। সবই স্বপ্নের মতো সুন্দর–কত সুন্দর! কত ভালো লাগল–তাই মনের আনন্দে কথা বলতে চাইলাম। গলার ভিতর শুধু ঘড়ঘড় করে উঠল। কিছুই বলতে পারলাম না। তোমাকে দেখেই বুঝলাম, তুমিই আমার স্রষ্টা। তোমার চোখমুখ সবই তা জানাচ্ছিল।
ইচ্ছা করছিল লাফিয়ে, হেঁটে, চলে এবং কথা বলে আমার আনন্দ প্রকাশ করি। কিন্তু তখনো সে শক্তি আমার হয়নি, তাই ব্যথায় ছটফট করতে লাগলাম।
তারপর পেলাম আমার শক্তি। ভালো করে দেখলাম তোমাকে তোমাকে আমার অত্যন্ত ভালো লাগল। কিন্তু দেখলাম, তোমার সমস্ত মুখ কেমন বেদনায় পার হয়ে উঠেছে। আমার দিকে বিজাতীয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুমি ছুটে চলে গেলে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু বুঝলাম না কেন–কীজন্য তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে।
মনে হল, তোমাকে আমার অনেক কথা বলা উচিত–অনেক কথা। তুমি আমার স্রষ্টা, আমার ভাগ্যবিধাতা, তোমার সঙ্গে কথা বলব না তো কার সঙ্গে বলব? তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাব না তো কাকে জানাব? গেলাম তোমার শোয়ার ঘরে। তোমার মশারি তুলে কথা বলতে গেলাম, কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই চমকে উঠলাম, দেখলাম–তুমি অসহনীয় ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলে।
মনের দুঃখে ঘরে ফিরে এলাম। কেন এই ঘৃণা! কেন? কেন? আমি কী করেছি? যদি ভালোবাসতেই না পারলে–যদি ঘৃণাই করবে, তবে হে বিধাতা, আমাকে জীবন দিলে কেন? যদি জীবনই দিলে তবে ভালোবাসবে না কেন? আমি তো তোমার কাছে জীবন চাইনি, তুমি তো স্বেচ্ছায় আমাকে সৃষ্টি করেছ। তবে আমার কিসের অপরাধ?
সমস্ত রাত একক নিঃসঙ্গতায়, প্রভু, তোমার কথাই ভেবেছি। মনকে এই বলে সান্তনা দিয়েছি যে দিনের আলোয় অন্ধকার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতি তোমার ঘৃণাও দূর হয়ে যাবে। আমাকে তুমি তোমার সন্তানের মতো বুকে তুলে নেবে।
হায়রে আশা ছলনাময়ী। সকাল হল, আকাশ রাঙিয়ে সূর্যদেব আকাশে উঠলেন–তুমি এলে না আমার খোঁজ নিতে। বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনে উৎসুক হয়ে মুখ বের করে দেখতে গেলাম–তুমি কি না! কিন্তু যাকে দেখলাম সে আমাকে দেখে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে ঘৃণা, আতঙ্ক ফুটে উঠল এবং পরমুহূর্তে সে পাগলের মতো ছুটে পালাল। আমারও তো প্রাণ আছে, আমারও তো চেতনা আছে। সমস্ত শরীর রাগে কাঁপতে লাগল–আমায় দেখে ঘৃণা! এত ঘৃণ্য আমি? এত কুৎসিত দেখতে আমাকে আমি তো ভালোই হতে চেয়েছি, আমি তো কারুর কোনো ক্ষতি করিনি।
তারপর মনে করে দেখ প্রভু, তোমরা সকলে মিলে আমার ওপর কী অকথ্য ও দুঃসহ অত্যাচার করেছ। চেয়ার দিয়ে আঘাত করেছ, কুকুর লাগিয়ে আহত করতে চেয়েছ, চাবুকে আমায় জর্জরিত করেছ, আগুন দিয়ে সমস্ত শরীরে জ্বালা ধরিয়েছ–কী দিয়ে তোমরা আমাকে শাসন করতে বাকি রেখেছ? নৃশংস অত্যাচারে আমার মত নিঃসহায় এক নতুন জীবকে তোমরা নবজন্মের প্রথম প্রভাতেই দুঃস্বপ্নের অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিলে। অজস্র অত্যাচারে আমাকে বারবার অজ্ঞান করেও তোমাদের আশা মেটেনি, তার ওপর আবার অনাহারে রেখেছিলে–একফোঁটা জলও পিপাসা মেটাতে দাওনি। প্রাণধারণের চেষ্টায় তাই তো আমাকে প্রথম মানুষ হত্যা করতে হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, প্রভু, আমি তা চাইনি। তোমরাই চেয়েছিলে আমাকে হত্যা করতে। আমি আত্মরক্ষা করেছি মাত্র। যখন আমাকে অস্ত্রোপচার করতে উদ্যত হলে তখন আমার ভয়। হল। মনে হল–তোমরা আমাকে বাঁচতে দেবে না, অথচ আমি যে বাঁচতে চাই। এত সুন্দর পৃথিবী আমি প্রাণভরে দেখতে চাই। তাই শুধু আত্মরক্ষার জন্য তোমার সঙ্গীকে আমি হত্যা করেছি। নয়তো সত্যি বলছি, হত্যা করতে আমার নিজের কোনো ইচ্ছা ছিল না। হিংসাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণাই করি।
তারপর ভয় হল, হয়তো আবার আমাকে শাসন করবে, অনিচ্ছাকৃত এই কুকীর্তির জন্য তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করবে। তাই পালালাম ওখান থেকে। কয়েকদিন বনে বনে থেকে পৃথিবীতে বাঁচার সমস্ত উপায় প্রায় জেনে নিলাম। অনেক চেষ্টা করে কথা কইতেও শিখলাম।
মনে হল, তোমরা তো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে, দেখি–পৃথিবীর সব লোকই তোমাদের মতো কি না, কেউ আমাকে ভালোবাসে কি না। তাই আবার লোকালয়ে ফিরে এলাম।
একদিন খুব ভোরবেলা। তখনো কুয়াশা প্রায় সমস্ত জগৎ আচ্ছন্ন করে আছে। আমি একটি ছোট্ট বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলেন এক লোক আর একটি ছোট মেয়ে। লোকটি বাইরে চলে গেলেন আর ছোট্ট মেয়েটি গেল সামনে দিঘির ধারে। আমার মনে হল, এই ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করি। গেলাম তার কাছে। তখনো কুয়াশায় আমাকে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না। মেয়েটির কাছে গিয়ে বললাম-খুক, আমি তোমার সঙ্গে খেলতে চাই।