প্রতিদিন তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতেন যে, যেন তার মনে একবার শান্তি ফিরে আসে, যেন তিনি পরিবারের প্রত্যেককে সান্ত্বনা দিতে পারেন, সুখী করতে পারেন। কিন্তু তা হতে পারে না। মনস্তাপ সমস্ত আশা নির্মূল করে দিয়ে যায়। তিনি এক ঘৃণ্য পশু সৃষ্টি করেছেন। প্রতিদিন তিনি ভয়ে ভয়ে থাকতেন– আবার কখন সেই দৈত্যটি এমন এক নৃশংস কুকীর্তি করবে যা তার অতীতের সমস্ত নিষ্ঠুরতাকে ছাপিয়ে যাবে। যতদিন তার প্রিয়তমদের মধ্যে একজনও জীবিত থাকবে ততদিন এই ভীতি থাকবেই। যখনই তার অপরাধ আর বিদ্বেষের কথা তার মনে হত তখনই তার প্রতি ঘৃণায় আর তার কৃতকর্মের জন্য প্রতিহিংসায় তার সমস্ত মন-প্রাণ অস্থির হয়ে উঠত। যদি এন্ডিস পর্বতের সুউচ্চ চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে তাকে হত্যা করা সম্ভব হত, তবে সেই দুর্গম পর্বতশিখরে ছুটে যেতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতেন না। মাঝে মাঝে তাকে সামনাসামনি পাওয়ার জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠতেন, এতগুলো লোককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার শাস্তি কীভাবে তাকে দেওয়া যায়–তা কল্পনা করতে না পেরে আরো অস্থির হয়ে উঠতেন।
এলিজাবেথ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতা, স্বর্গ বা মর্তের সৌন্দর্য তাঁর আত্মাকে দুঃখের থেকে মুক্তি দিতে পারত না; বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, দয়া, মায়া, মমতা–তার বিকল হৃদয়ের কাছে বিফল। তাকে ঘিরে যেন এক কালো মেঘ, যাকে ভেদ করে কোনোকিছু ভালো কাছে যেতে পারে না। একটি আহত হরিণ যেমন নিজের অসাড় দেহকে টানতে টানতে এক নির্জন স্থানে এনে তার দেহ-বিদ্ধ তীরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে, তারও ঠিক সেই একই অবস্থা।
.
এই রকম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে একদিন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। আল্পস্ পাহাড়ের উপর উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মানসিক অবসাদকে নিমগ্ন করে দিতে চাইলেন তিনি। সামুনি উপত্যকার দিকে তিনি পা বাড়ালেন। সারভক্স উপত্যকার মতো সুন্দর না হলেও এই উপত্যকা অপূর্ব মহিমময়। উঁচু তুষারমণ্ডিত পর্বত দিয়ে এই উপত্যকার সীমারেখা আঁকা, কোথাও পাহাড়ের উপর বিধ্বস্ত দুর্গের চিহ্ন নেই। বিরাট হিমানীপ্রবাহের পতনের গুরুগম্ভীর শব্দ আর তার যাত্রাপথ ধরে শীতল ধোয়া সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে রাখে। সব ছাপিয়ে সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ মঁ ব্লাঁ–একেশ্বরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।
বিমুগ্ধ নয়নে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেই নৈসর্গিক শোভা দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন দূর থেকে মানুষের চেহারার মতো কী একটা যেন অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে তার দিকে ছুটে আসছে। বিপদসঙ্কুল বরফের চাঁইয়ের উপর দিয়ে সে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, যা যে-কোনো মানুষের পক্ষেই বিপজ্জনক। তার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। যতই সেই মূর্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, ততই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে সে আর কেউ নয়, তার সৃষ্ট সেই শয়তান। তার সঙ্গে চিরকালের মতো শেষ বোঝাঁপড়ার জন্য তিনি মনে-মনে তৈরি হলেন।
তিনি ছুটে গেলেন তার দিকে। চিৎকার করে উঠলেন–শয়তান! পিশাচ! তুই-ই আমার ছোটভাইকে খুন করেছিস! তোর জন্যই জাস্টিনের ফাঁসি হয়েছে। আমি তোক কী করতে পারি জানিস? আবার তুই আমার সামনে এসেছিস? চলে যা, দূর হ–
সে দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক হয়ে। তারপর চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়াল। তিনি আবার বললেন–কোথায় যাচ্ছিস? আগে যাদের তুই খুন করেছিস, তাদের সকলকে ফিরিয়ে দিয়ে যা। নয়তো আমিই গড়েছি তোকে, আমিই আবার তোকে ভেঙে চুরমার করে দেব।
খানিকক্ষণ সে ব্যথিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তার পীতাভ চোখদুটো তুলে ধরল। বলল–যতখানি ব্যথা দেবে ভেবেছিলে, ততখানি পাইনি। আমি তোমার কাছে অনেকটা এইরকম ব্যবহার আশা করেছিলাম, ঠিক তাই-ই পেয়েছি। কিন্তু কেন আমাকে ঘৃণা করো?কেন আমাকে হত্যা করতে চাও?
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চোখদুটো অসহ্য রাগে জ্বলে উঠল, বললেন–কেন হত্যা করতে চাই। আমি তোক সৃষ্টি করেছিলাম অতিমানুষ করার জন্য, কিন্তু তুই অমানুষ হলি। তারপর তুই যথেচ্ছাচার করে চলেছিস। মানুষের রক্তে সারা পৃথিবী রাঙিয়ে দিয়ে তোর তৃপ্তি হল না, তার ওপর আমারই ছোটভাইকে হত্যা করেছিস? আমি তোর সৃষ্টিকর্তা–আর আমারই সংসারে তুই মৃত্যুর কালিমা এনে দিয়েছিস!
দৈত্যের চোখ বোধ হয় ছলছল করে উঠল, বলল তোমার ভাইকে হত্যা করার ইচ্ছা ছিল না আমার। সত্যি বলছি, হে আমার ভগবান, আমায় বিশ্বাস। করো। সব ঘটনাই তোমাকে একে একে বলছি, কিন্তু তার আগে তুমি আমায় ক্ষমা করো। বলো ক্ষমা করলে।
তিনি বিদ্রূপের হাসি হেসে উঠলেন–ক্ষমা! বলতে লজ্জা করে না? তুই এমন। এক সৃষ্টি-যে চারদিকে অশান্তি আনছে। যার নিছক আনন্দ হচ্ছে লোককে খুন করা। তুই আমার চোখের ঘুম নিয়েছিস, মুখের হাসি নিয়েছিস, মনের শান্তি নিয়েছিসতোকে ক্ষমা করব? শয়তান!
এবারে দৈত্যটি যেন সত্যিই কেঁদে ফেলল, বলল–আমি জানি, আমার জীবনের সমস্ত দুঃখময় কাহিনী শুনলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে। তুমি আমার স্রষ্টা, কিন্তু তুমিই আমার সমস্ত দুঃখের কারণ। তাই আজ তোমাকেই আমি শুধু বলতে চাই, কেন আমি হিংসাবৃত্তি নিলাম। তুমি ততটুকু শুধু ধৈর্য ধর। তারপর তোমার যা খুশি তাই করো। শুধু আজ আমার একটু কথা শোনো–