তারপর উঠল এলিজাবেথ। সে বলল–আমি নিহত শিশু উইলিয়মের পরিবারে শিশুবয়স থেকে আছি। উইলিয়মের বাবা-মাকে নিজের বাপ-মায়ের মতো দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকেও সেই ব্যবহার পেয়ে এসেছি। আমি জাস্টিনকে অনেকদিন ধরে জানি, একই বাড়িতে আমরা প্রায় সাত বছর একত্রে বাস করেছি। তার মতো ভদ্র, অমায়িক ও স্নেহবৎসলা আমি খুব কম দেখেছি। মিসেস ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অসুখের সময় সে অত্যন্ত যত্ন এবং দায়িত্বের সঙ্গে তার সেবা করেছে। এই পরিবারের প্রত্যেকেই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন। যে শিশুর হত্যার অপরাধে জাস্টিন অভিযুক্ত হয়েছে তাকে সে নিজের ছেলের মতো এতদিন দেখেছে। তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ সত্ত্বেও আমি তার সম্পূর্ণ নির্দোষিতায় বিশ্বাস করি। এই জঘন্য পাপকাজ করার মতো কোনো প্রবৃত্তি তার হতে পারে না, কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে সে এ-কাজ করতে পারে না। সে যদি চাইত তবে আমি সামান্য ওই লকেট কেন, আরো অনেক দামি জিনিস তাকে আনন্দে দিতাম–এতখানি আমি তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি।
এলিজাবেথের এই অকপট ও মর্মগ্ৰাহী আবেদনে সমস্ত আদালতের মধ্যে অস্কুট গুঞ্জন শোনা গেল; কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এই আলোড়ন শুধু এলিজাবেথের সুন্দর জবানিতে জাস্টিনের অপরাধ মার্জনার আবেদনের জন্য–জাস্টিনের ওপর তাদের এতটুকু সহানুভূতি হল না। বরং ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মহানুভবতার প্রতিদানে এই জঘন্য অকৃতজ্ঞতায় সকলের মন তার ওপর বেশি বিরূপ হয়ে উঠল।
এলিজাবেথের কথা শুনতে শুনতে জাস্টিন কেঁদে ফেলেছিল, কিন্তু সে একটি কথাও বলেনি। বিচারের সবটুকু সময় ধরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মনের মধ্যে যে তোলপাড় হচ্ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জাস্টিন যে সম্পূর্ণ নির্দোষ সে-সম্বন্ধে তার এতটুকু দ্বিধা ছিল না। তিনি একথা জানতেন। তবে কি সেই দৈত্য তার ভাইকে হত্যা করে পৈশাচিক উন্মত্ততায় এই নির্দোষ পরিচারিকার জামার পকেটে সেই লকেটটা রেখে গেছিল?
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল, তারপর দ্রুতগতিতে ঘুরতে লাগল। একটা অগ্নিবলয় সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করতে করতে আসছে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ, তারপর অন্ধকার… অন্ধকার, আর সেই কালিমার মধ্য থেকে একটি পৈশাচিক মূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।
সারা আদালতে তুমুল চাঞ্চল্য। জাস্টিন অপরাধ স্বীকার করেছে, বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
জাস্টিনকে প্রহরীরা নিয়ে যাচ্ছে। এলিজাবেথ ছুটে গেল, বলল–জাস্টিন, তুমি এ কী করলে? আমার শেষ সান্ত্বনাটুকুও তুমি কেড়ে নিলে? তুমি–তুমি উইলিয়মকে হত্যা করেছে?
জাস্টিন তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল–এলিজা, তুমি কি আমাকে এত
নীচ মনে করো? তুমি কি সত্যই মনে করতে পারো যে আমি উইলিয়মকে হত্যা। করেছি। কিন্তু কী করব? মুক্তি পেলেও সকলের কাছে আমি ঘৃণ্য হয়ে থাকব, কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি নির্দোষ। আর তা ছাড়া উইলিয়মকে আমি নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছি। তাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব? তার চেয়ে এই ভালো, স্বর্গে উইলিয়মের সঙ্গে আমার দেখা হবে এবং আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারব।
৭-৮. দৈত্যের আবির্ভাব
পর পর দ্রুতগতিতে কয়েকটি অস্বাভাবিক ঘটনা সংঘটনের ফলে মানুষের অনুভূতি উত্তেজনার চরম শিখরে ওঠার পর যে নিষ্ক্রিয় জড়তা মৃত্যুর মতো সমস্ত দেহকে শীতল করে রাখে, তার চেয়ে বেদনাকর বোধহয় আর কিছুই নেই। মানুষ তখন আশা-ভরসা, জীবন-মৃত্যু, ভয়-ভাবনার অতীত। জাস্টিনের ফাঁসি হয়েছে, মৃত্যুর পরে সে শান্তি লাভ করেছে; কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আজও জীবিত, সমস্ত হৃদয় জুড়ে নৈরাশ্য আর বেদনা। তার চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। এক লক্ষ্যহীন প্রেতাত্মার মতো তিনি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। অবর্ণনীয় বীভৎস অন্যায় তিনি করেছেন এবং সেই পাপের ফলে ভবিষ্যতে আরো কত বীভৎস ঘটনা ঘটবে। অতীতের দিকে তাকিয়ে তিনি কোথাও এতটুকু খুশির আলো দেখতে পেলেন না, ভবিষ্যতে কোনো আশার স্বাক্ষর নেই। তাঁর সমস্ত মন ধীরে ধীরে আগ্রাসী বিমর্ষতায় অধিকার করল, নিজেকে মনে হল ঘৃণ্য অপরাধী–তারপর যে মানসিক অত্যাচার, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
মানসিক এই অবস্থায় তার শরীর ভেঙে গেল। বিজ্ঞান-সাধনার পুরস্কারের পরিবর্তে প্রথম রূঢ় আঘাতের পর থেকেই তিনি শারীরিক বিশেষ সুস্থ ছিলেন না। তিনি লোকের সঙ্গ এড়িয়ে যেতে লাগলেন। কোথাও কোনো আনন্দ বা কারুর এতটুকু আত্মপ্রসাদ তাঁর কাছে নির্যাতন বলে মনে হত! নির্জনতা–গভীর, অন্ধকার মৃত্যুর মতো নির্জনতা ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা।
বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে পরে প্রায়ই গভীর রাত্রে তিনি নৌকো নিয়ে লেকে একা অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো কখনো লেকের মাঝখানে এসে হাল তুলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন–নৌকোটি নিজের খুশিমতো যেমন ইচ্ছ, যেখানে ইচ্ছা যাক। লেকের জলে তার কুৎসিত ছায়া দেখে ভাবতেন যে এত সুন্দর স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে শুধু গুটিকয় ব্যাঙ বা বাদুড় ছাড়া তাঁর মতো অস্থির, তাঁর মতো কুৎসিত আর কেউ নেই। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হত যে শান্ত শীতল লেকের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে; লেকের নির্মল জলে তার সমস্ত ভয়, ভাবনা, দুঃখ, অশান্তির পরিসমাপ্তি এনে দিতে। কিন্তু তখনই মনে হত তাঁর বাড়ির লোকজনের কথা। নিজে আত্মরক্ষা করে আর সকলকে সেই শয়তানের নিষ্ঠুর হিংস্রতার মুখে ঠেলে দিয়ে যাবেন!