ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন জিজ্ঞাসা করলেন–বাবা কেমন আছেন?
ভালোই আছেন–এলিজাবেথ উত্তর দিল। হত্যাকারী ধরা পড়ার পর থেকেই–
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন চিৎকার করে উঠলেন–হত্যাকারী ধরা পড়েছে? অসম্ভব! কে তাকে ধরতে পারবে? কার এত ক্ষমতা আছে। এর চেয়ে বরং ঝড়ের চেয়ে জোরে ছোটা সম্ভব! আমিও তাকে দেখেছি, কাল রাত পর্যন্ত সে মুক্ত ছিল।
এলিজাবেথ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল–তুমি কী বলছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়ার পর আমরাও একেবারে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি, তার বিরুদ্ধে সমস্ত রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাড়ির কেউ এখনো বিশ্বাস করে না। কে বিশ্বাস করতে পারে যে আমাদের এতদিনকার পরিচারিকা জাস্টিন–যে উইলিয়ম আর আর্নেস্টকে ছেলের মতো মানুষ করেছে–সে-ই উইলিয়মকে হত্যা করবে? এতবড় ঘৃণ্য পাপ করবে!
–জাস্টিন! অসম্ভব। তাকেই কি হত্যাকারী বলে ধরা হয়েছে।
–হ্যাঁ। বিশ্বাস হয় না, তবু তার বিরুদ্ধে এত প্রমাণ! তাছাড়া উইলিয়মের মৃত্যুর পর থেকে তার হাবভাবও কেমন যেন অদ্ভুত। আজই তার বিচার হবে, তখনই সব কথা পরিষ্কার হবে।
এলিজাবেথ জানাল যে উইলিয়মের মৃত্যুর পর জাস্টিন বেশ কয়দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। সেই সময় বাড়ির এক চাকর তার জামাকাপড় খুঁজতে খুঁজতে উইলিয়মের মৃত্যুর দিন সে যে-জামা পরেছিল, তার পকেট থেকে তোমার মা’র মীনে-করা লকেটটা পায়। সে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে সোজা পুলিশকে গিয়ে খবর দেয়। পুলিশ তাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করে ধরে নিয়ে গেছে।
আশ্চর্য এই কাহিনী। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–এলিজা! তোমরা সকলে ভুল করছ। জাস্টিন নির্দোষ, আমি জানি কে হত্যাকারী!
এমন সময় ধীরে ধীরে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে এলিজাবেথ বলে উঠল–শুনেছেন, ভিক্টর জানে যে কে হত্যাকারী!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বাবা আস্তে আস্তে উত্তর দিলেন–আমাদেরও দুর্ভাগ্য যে আমরাও তাকে জানি।
এলিজাবেথ বলল- ভিক্টর বলছে জাস্টিন নয়, জাস্টিন নির্দোষ।
উত্তর এল–তাই যেন হয়, জাস্টিন যেন নির্দোষ প্রমাণিত হয়।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মন কিছুটা স্থির হল। জাস্টিনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ দাখিল করা সম্ভব নয় বলে সে খালাস পেয়ে যাবে। তার হত্যাকারীর কাহিনী এত অবাস্তব এবং এত অবিশ্বাস্য যে সকলকে সে কাহিনী বলাও যাবে না, কেউ বিশ্বাসও করবে না।
.
এগারোটায় জাস্টিনের বিচার হবে। সপরিবারে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আদালতে উপস্থিত হলেন। বিচারের এই প্রহসনের সমস্তক্ষণ তিনি নরকযন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলেন। তার কৌতূহল ও বেআইনি কাজের ফলে যে শিশু নিহত হয়েছে, চিরকালের জন্য সেই হত্যার ঘৃণ্য অপবাদ মাথায় নিয়ে জাস্টিন জীবিত থাকবে কি? অথচ এই সমস্ত অপকর্মের জন্য দায়ী একমাত্র তিনি। হাজার বার তিনি সকলের সামনে এই হত্যার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। সমস্ত অপরাধ তিনি স্বীকার করতে পারলে খুশিই হবেন–কিন্তু হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তিনি এতদূরে ছিলেন যে কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না, পাগলের প্রলাপ বলে তাঁর কথা উড়িয়ে দেবে।
বিচার আরম্ভ হল। জাস্টিনের মুখ ভীতিহীন; সে নির্বাক হয়ে বসে আছে। শত চক্ষুর উৎসুক দৃষ্টিতেও সে বিচলিত নয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিবৃত করলেন সরকারি উকিল। উইলিয়মের হত্যাকাণ্ডের দিন সারারাত জাস্টিন বাড়িতে ছিল না। ভোরের দিকে তাকে একজন দেখতে পায় হত্যাস্থানের কাছাকাছিই। সেখানে সে কী করছে জিজ্ঞাসা করায় ঠিকমতো উত্তর দিতে পারেনি। বাড়িতে ফেরার পর সকলে যখন তাকে জিজ্ঞাসা করল যে সে সারারাত কোথায় ছিল, তখন সে উত্তর দিয়েছিল যে সে উইলিয়মকে খুঁজছিল। উইলিয়মের মৃতদেহ তাকে দেখানোমাত্র সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এবং কয়দিন বিছানায় শুয়ে ছিল। তারপর সরকারি উকিল মীনে-করা একটি সোনার লকেট বের করে বললেন–এই সেই লকেট যেটি মৃত্যুর পূর্বে শিশুটির গলায় ছিল এবং মৃত্যুর পর এই মেয়েটির জামার পকেট থেকে পাওয়া যায়।
একথা শোনামাত্র আদালতের মধ্যে ধিক্কার-ধ্বনি শোনা গেল।
জাস্টিনকে তার উত্তর দিতে বলা হল। জাস্টিন বলতে লাগল–ভগবান জানেন যে আমি নির্দোষ। যে উইলিয়মকে আমি নিজের ছেলের মতো প্রতিপালন করেছি, তার একটি ছোট লকেটের লোভে আমি তাকে হত্যা করব–একথা সকলে বিশ্বাস করলেও ভগবান বিশ্বাস করবেন না।
একটু থেমে সে বলে যেতে লাগল যে হত্যাকাণ্ডের রাত্রে সে এলিজাবেথের অনুমতি নিয়েই জেনেভার কাছাকাছি সেনে গ্রামে তার মাসির বাড়িতে গেছিল। রাত ন’টার সময় ফেরার পথে একজন লোকের কাছে সে প্রথম সংবাদ পায় যে উইলিয়মকে পাওয়া যাচ্ছে না। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে সে অনেকক্ষণ ধরে চারদিক খোঁজ করে। যখন খেয়াল হল, তখন জেনেভা নগরীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কাছাকাছি একটা পোড়ো ঘরে সে আশ্রয় নেয় এবং সারারাত সেখানেই থাকে। মনে হয়, সে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। কারুর পায়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়নি। সকাল হলে সে বাড়ি ফিরে আসে। কেউ যদি তাকে হত্যাকাণ্ডের স্থানে দেখে থাকে, হয়তো সে যখন উইলিয়মকে খুঁজছিল তখন দেখেছে। যদি সে হত্যাকাণ্ডের স্থানে গিয়ে থাকে তবে সে নিজের অজান্তেই গেছে। লকেটের সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই।