তোমার হতভাগ্য বাবা
.
উইলিয়মের মৃত্যু-সংবাদ শুনে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শোক-বিমূঢ় হয়ে গেলেন। আর দেরি করলেন না, সেইদিনই তিনি জেনেভার পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখানে থাকতেও তার ইচ্ছা হচ্ছিল না, একা থাকবার খুব সাহসও ছিল না–কখন আবার সেই বিরাটাকার দানব সামনে এসে দাঁড়াবে। তা ছাড়া, মনে মনে ভাবলেন তিনি, উইলিয়ামের হত্যাকারী সেই দস্যুকে ধরে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করাও প্রয়োজন।
কিন্তু সে যাত্রা কী বেদনাময়। প্রথমে তার মনে হয়েছিল যে যত শীঘ্র পারা যায় তিনি যাবেন, কিন্তু যতই তিনি যেতে লাগলেন ততই মনের কোণে বিষাদ জমে তার গতিকে মন্থর করে তুলতে লাগল। চারদিকে তিনি তাকিয়ে দেখলেন, শুধু তুষার আর তুষারের পাহাড়। আকাশ থেকে আরম্ভ করে মাটি পর্যন্ত সমস্ত যেন তুষারের সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আকাশে পাহাড়ে গাছপালায়–সব জায়গায় যেন তিনি শুনতে পাচ্ছেন এক করুণ আর্তনাদ। আকাশের আলো যেন নিভে আসতে লাগল।
অতীতে কতবার তিনি এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করেছেন, তার সুখকর স্মৃতি মনে পড়ল; কিন্তু মাত্র এই একটি আঘাত কেমন করে যেন এক বিরাট পরিবর্তন এনেছে। সর্বত্রই যেন তিনি নাম-না-জানা বিভীষিকা দেখতে পাচ্ছিলেন, ভয়ে সমস্ত শরীর যেন তার পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিল।
দুদিন অপেক্ষা করলেন তিনি সুজানে।
.
৬. দানবের অপকীর্তি
লেকের পাশ দিয়ে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দেশ জেনেভায়। দূর থেকে তিনি দেখলেন তুষারশৃঙ্গ ম ব্লা। তার সৌন্দর্যে তাঁর পূর্বস্মৃতি আবার জেগে উঠল, তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন–আমার সোনার দেশ, আমার সোনার পাহাড়, তোমাদের প্রবাসী ছেলে আজ ঘরে ফিরে আসছে। তোমাদের মুখে প্রশান্তির ছবি–তা কি আমাকে সান্তনা দিতে, না আমার গভীর দুঃখে ব্যঙ্গ করতে?
যতই জেনেভার দিকে এগোতে লাগলেন, ততই এক বিমর্ষ বিষণ্ণতা আর অনিশ্চিত ভয়ে তাঁর মন ভরে উঠল। নিঃশব্দ চরণে কখন চারদিকে রাত নেমে এসেছে, অন্ধকার পাহাড়ে কুয়াশার আস্তরণ। সমস্ত পৃথিবী যেন এক বিরাট নির্মম বিভীষিকার ছবি।
যখন জেনেভায় এসে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন পৌঁছুলেন, তখন নগরীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল না হলে আর জেনেভায় প্রবেশ করা যাবে না। বাধ্য হয়ে তাঁকে নগরীর থেকে কিছুদূরে সেকেরন গ্রামে সেই রাতের জন্য থাকতে হল। সমস্ত আকাশ কালো, একটি তারার চোখও দেখা যাচ্ছে না। তিনি মনে মনে এক নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এরই কাছে তার ছোটভাই উইলিয়ম নিহত হয়েছে। যেই এই কথা মনে হল, তক্ষুনি তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর প্রিয়তম ভাইয়ের মৃত্যুস্থান একবার দেখার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
পথে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আকাশে তখন ঘনঘটা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোর প্রতিফলনে ম ব্লার তুষারশৃঙ্গ আলোকিত হয় উঠে কত রকমের সুন্দর ছবি একে যাচ্ছে। গাছপালা কাঁপিয়ে ঝোড়ো বাতাস ছুটে আসছে; তিনি একটি ছোট টিলার উপর উঠে দাঁড়ালেন।
বৃষ্টি শুরু হল। তিনি হাঁটতে লাগলেন। কাছেই ভীষণ শব্দ করে বজ্রপাত হল, তার প্রতিধ্বনি দূরের যঁ ব্লা আল্পস থেকে ফিরে এল। বিদ্যুতের চুলকানিতে তাঁর চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে, সামনের জেনেভা লেক মনে হল এক অগ্নিকুণ্ড। তারপর নিরঞ্জ অন্ধকার।
বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি সেই সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর ঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তার মনে হল যেন কাছেরই এক ঝোঁপের ভিতর থেকে এক কালো মূর্তি আত্মপ্রকাশ কলল। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। বিদ্যুতের আলোর ঝলকে সেই মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার দানবীয় বিকলাঙ্গ চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই সেই শয়তান, সেই নিষ্ঠুর দৈত্য–যাকে তিনি জীবন দান করেছেন। এই শয়তান, এখানে কী করছে? তবে কি তবে কি এই শয়তানই তার ভাইকে হত্যা করেছে? একথা মনে করতেই তার দেহের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে এল। তিনি একটি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। সেই মূর্তিটি মুহূর্তের মধ্যে তাকে অতিক্রম করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোনো মানুষ ফুলের মতো সুন্দর ছেলেকে হত্যা করতে পারে না। নিশ্চয়ই এই শয়তানই হত্যাকারী! একবার মনে হল যে তার পিছু তিনি ধাওয়া করেন, কিন্তু সেই দৈত্য ম সালেভের খাড়া চূড়া ডিঙিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
সারারাত তিনি এক অস্বস্তিকর মানসিক যন্ত্রণায় কাটালেন। বাইরের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাঁর মানসিক অস্থিরতা যেন আরো বেড়ে গেল। একটির পর একটি কলুষ বিভীষিকাময় দৃশ্যের ভিতর দিয়ে তার কল্পনা ছুটে চলল। তাঁর শুধু মনে হতে লাগল সেই অমানুষিক অপার্থিব জীবের কথা–যাকে তিনি বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিষ্কার রূপে সৃষ্টি করেছিলেন, যাকে তিনি জীবন ও শক্তি দিয়েছিলেন এবং যাকে তিনি মনুষ্যসমাজে বিচরণ করতে ছেড়ে দিয়েছেন, যার একটির পর একটি নৃশংস কুকীর্তিতে নিজের ওপর ঘৃণা ছাড়া আর তাঁর কিছুই মনে আসে না।
এইভাবে যন্ত্রণাময় এক সুদীর্ঘ রাত কেটে গেল। জেনেভা নগরীর দরজা খোলামাত্র তিনি ছুটে বাড়িতে এলেন। প্রথমেই দেখা হল এলিজাবেথের সঙ্গে। তাকে দেখে এলিজাবেথ কেঁদে ফেলল। বলল–ভিক্টর, তুমি এলে, কিন্তু আর কিছুদিন আগে এলে না কেন? কত দুঃখের মধ্যে তুমি এলে।