ক্লেরতালের সেবা-শুশ্রষা ও পরিচর্যায় বেশ কয়েক দিন পরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সুস্থ হয়ে উঠলেন। ক্লেরভাল বন্ধুর সঙ্গে অত্যধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কুফল নিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করামাত্রই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বলে উঠলেন–তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা ভালো, না মন্দ–সে সম্বন্ধেও একটা কথা বলব না। তবে আজ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে আর আমি গবেষণা করব না। আমি পরাজিত। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম, জয়ের নেশায় আমি কোনোদিকে ভুক্ষেপ করিনি; কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব, পরাজিত ও বিধ্বস্ত। এতখানি আত্মগ্লানি নিয়ে আর গবেষণা করা সম্ভব নয়। তোমাকে কথা দিচ্ছি বন্ধু–এই শেষ। তুমি চলে যাও, আর কয়েকদিন পরে এই ল্যাবরেটরির একটা ব্যবস্থা করে আমিও দেশে ফিরে যাব। জেনেভাতে ক্লেরভালের অনেক কাজ পড়ে ছিল। তাই বাধ্য হয়ে বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করে ক্লেরভাল একা ফিরে গেলেন।
.
ক্লেরভাল চলে গেলে পর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের একে একে মনে পড়ল আগেকার সমস্ত কথা। তার সৃষ্টি সেই অপার্থিব বীভৎসতা। ক্লেরভাল কি তার খবর জানে? তাকে কি সে দেখেছে? কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, না–ক্লেরভাল নিশ্চয়ই দেখেনি, দেখলে সে তাকে এ-কথাটা জানাত।
ঘরের থেকে বেরিয়ে তিনি একবার বাইরের দিকে তাকালেন। দূরে পাহাড়ের মাথায় মাথায় তুষার-মুকুট সোনালি রোদে ঝকমক করছে, পপলার গাছগুলো মাথা দুলিয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সমস্ত পৃথিবী রঙিন হয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
চারদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন তিনি, কোথাও সেই দুষ্ট রাহুর চিহ্ন নেই। এক প্রসন্ন শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠল। মনে হল যেন তিনি আবার নতুন করে জীবন লাভ করলেন। আর বোধহয় সেই বিকট উন্দ্রব এখানে মুখ দেখাতে আসবে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে নিশ্চয়ই এই দুঃসহ শীতে বাইরে জমে সে মারা গেছে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি বাচলেন।
এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার সদিচ্ছা তার মন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। দেশে ফিরে যাওয়ার দিন একটু একটু করে পিছিয়ে দিতে লাগলেন।
একদিন তিনি বেড়িয়ে ফিরে দেখলেন যে বাইরের ঘরে টেবিলের উপর তার বাবার একটা চিঠি পড়ে আছে। একনিমেষে তার আবার মনে পড়ে গেল বাবা, উইলিয়ম, আর্নেস্ট ও এলিজাবেথের কথা। বাড়ির সুন্দর জীবনের কথা আবার নতুন করে মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তাই ভালো–সেখানেই চলে যাবেন তিনি। সকলের সঙ্গে একত্র থাকলে এই অনিশ্চিত বিভীষিকার হাত থেকে অনায়াসে আত্মরক্ষা করা যাবে। আর তা ছাড়া মার মৃত্যুর পর একবার সকলের সঙ্গে দেখা করাও প্রয়োজন!
কিন্তু চিঠিখানা খুলে তিনি নিশ্চল হয়ে গেলেন। হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। তিনি পড়তে লাগলেন :
প্রিয়তম ভিক্টর,
ক্লেরভালের কাছ থেকে জানলাম যে তুমি শীঘ্রই দেশে ফিরে আসছ। তুমি ফিরে এলে তোমাকে আনন্দের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাব–একথা যদি মনে করে থাকে, তা ভুল–ভুল। তুমি এসে আমাদের হাসিমুখ দেখবে যদি মনে করে থাকো তো আশ্চর্য হবে আমাদের চোখে জল দেখে। ভিক্টর, তোমাকে কী করে আমাদের এতবড় সর্বনাশের খবর দেব?
ভিক্টর, উইলিয়ম মারা গেছে। সত্যকথা বলতে গেলে উইলিয়মকে কে যেন হত্যা করেছে। তোমাকে সান্ত্বনা দেব না, শুধু ঘটনাটা আমি লিপিবদ্ধ করছি।
গত বৃহস্পতিবার আমি, এলিজাবেথ আর তোমার দুই ভাই উইলিয়ম ও আর্নেস্ট বেড়াতে গেছিলাম। জায়গাটা এত সুন্দর যে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। ফেরার সময় উইলিয়ম ও আর্নেস্টকে দেখতে পেলাম না। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে আর্নেস্ট ফিরে এল। জিজ্ঞাসা করল যে আমরা উইলিয়মকে দেখেছি কি না। সে জানাল যে তারা দুজনে লুকোচুরি খেলছিল। উইলিয়ম দৌড়ে গিয়ে কোথায় যে লুকোল, আর্নেস্ট তাকে খুঁজে পায়নি।
একথা শুনে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। রাত অন্ধকার হয়ে না-আসা পর্যন্ত আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এলিজাবেথ বলল, হয়তো সে বাড়ি ফিরে গেছে। আমরা ছুটে এলাম বাড়িতে, কিন্তু সেখানেও সে নেই। আবার আমরা আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই শীতের রাতে অন্ধকারে একা না-জানি সে ভয়ে কী করছে। ভোর প্রায় পাঁচটার সময় তার খোঁজ পেলাম–সুন্দর ফুটফুটে উইলিয়ম ঘাসের উপর নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। তার গলায় হত্যাকারীর আঙুলের চিহ্ন তখনো জ্বলজ্বল করছে। তোমার মার ছবি মীনে-করা সোনার লকেটটা তার গলায় ছিল, সেটি পাওয়া গেল না। সেই সোনার লকেটের লোভে ফুলের মতো সুন্দর ছেলেটিকে দত্যু হত্যা করেছে।
এলিজাবেথ শোকে পাগল হয়ে উঠেছে। আর্নেস্টের ধারণা : সে-ই তার। ছোটভাই-এর মৃত্যুর জন্য দায়ী, কারণ সে লুকোচুরি খেলতে না চাইলে উইলিয়মের এভাবে মৃত্যু হত না। আমাদের এরকম সুখের বাড়িতে আজ গভীর বিষাদের ছায়া সকলের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। হত্যাকারী আজও ধরা পড়েনি; কিন্তু আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। আমাদের সকলের সম্মিলিত অনুসন্ধানে তার ধরা পড়তেই হবে। ভিক্টর, তুমি তাড়াতাড়ি এসো। তুমি ছাড়া এলিজাবেথকে আর কেউ সান্ত্বনা দিতে পারবে না। তুমি এলে আমরা সকলেই মনে বল পাব। ইতি–