.
এইভাবে একের পর এক সুদীর্ঘ দিন, সুদীর্ঘতর রাত কেটে যায়। একই উৎকণ্ঠায়, একই আতঙ্কে ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের নিঃসঙ্গ দিন কেটে যায়। মনে হয়, দূরে কোথাও এক অশরীরী ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেই দৈত্যকে তিনি স্বচক্ষে দেখেননি। মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, এই তুষার-ঝরা কঠিন শীতের রাতে আশ্রয়হীন, বন্ধুহীন সেই দানবটি হয়তো ঠাণ্ডায় জমে বিনষ্ট হয়েছে। একটু আশার আলোয় মুখ উদ্ভাসিত হওয়ার পরমুহূর্তেই সংশয়ের কালো ছায়া এসে তাকে ঘিরে ফেলে। একা নির্বান্ধব এই সংশয়ে দিনের পর দিন থাকায় তাঁর আত্মবিশ্বাস শিথিল হয়ে পড়েছিল।
সেদিন সকাল থেকে ঝড়! আকাশ থেকে অবিশ্রান্ত তুষার ঝরে পড়ছে। এমন সময় মনে হল–কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন চমকে উঠলেন। তবে কী–তবে কী–?
সমস্ত শরীরের রক্ত জমাট হয়ে উঠল যেন!
আবার…আবার দরজায় ধাক্কা! মনে হল একবার চিৎকার করে ওঠেন : কিন্তু এই জনমানবহীন বিজন প্রদেশে কে তার চিৎকারে সাড়া দেবে?
–ভিক্টর! ভিক্টর!!
কার যেন নিচ থেকে গলা শোনা যায়! ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন। এ যে–
–ভিক্টর! ভিক্টর!!
হ্যাঁ–এ যে রেভালের কণ্ঠস্বর! ক্লেরভাল–তার চিরসুহৃদ এসেছে। আড়ষ্ট শরীর একমুহূর্তে যেন সচল হয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে তিনি সদর দরজা খুললেন।
ক্লেরভাল ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন; বললেন–এ কী হয়েছে বন্ধু তোমার? চেহারা কেমন করে এমন বিশ্রী হল?
গলা, হাত এবং পা কাঁপছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের। মনে হল যেন একটুও দ্বিধা না করে এই মুহূর্তে সব কথা প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত তিনি তাকে বলে এই ভারাক্রান্ত হৃদয়কে একটু হালকা করে ফেলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত সাহস হল না। শুধু অস্কুটস্বরে বললেন–কাজের চাপে শরীরের ওপর অত্যাচার হয়েছে যথেষ্ট। তাই–।
বন্ধুকে বসবার ঘরে নিয়ে যেতে সাহস হচ্ছে না। যদি সেই বিকট মূর্তির সঙ্গে আবার দেখা হয়। তার যে শাস্তি হবার তা তো হয়েছেই, মিছিমিছি কেন বন্ধুর সুখ-শান্তি হরণ করবেন? ক্লেরভালকে সেখানে বসিয়ে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ভয়ে ভয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন। কান পেতে যেন কিছু শুনতে চাইলেন। কিন্তু না, সেখানে কোনো শব্দ নেই। বসবার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরটায় একবার উঁকি মারলেন। না, সে নেই। সে নেই-ইচ্ছা হল, মনের আনন্দে একবার প্রাণ খুলে হাসেন, কিন্তু পারলেন না। চোখের কোণে শুধু অশ্রু জমে উঠল। সে কি আনন্দে, না বেদনায় তার সৃষ্ট প্রথম অতিমানবের বিভীষিকাময় উপস্থিতির অভাবের স্বস্তিতে, না তাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার ব্যথায়?
ক্লেরভালকে নিয়ে বসবার ঘরে এলেন তিনি। মনের উদ্বেগকে চাপবার জন্য অফুরন্ত কথা বলে যেতে লাগলেন, কিন্তু সবই যেন অবান্তর এবং সবই যেন অসঙ্গত প্রলাপ বলে নিজেই বুঝতে পারছিলেন। তবু এতদিন পর একটু কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি আর থামতে পারছেন না।
ক্লেরভাল প্রশ্ন করলেন–তোমার কী হয়েছে? চোখমুখের অবস্থা এমন হয়েছে কেন? তুমি অত কথা বলছ কেন?
কিছুই না, এমনি হয়তো ম্লানমুখে জবাব দেন তিনি।
একসময় ক্লেরভাল জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার রিসার্চের কতদূর? আর ডক্টর নীল-ই বা গেলেন কোথায়!
মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের সমস্ত রক্ত অন্তর্হিত হয়ে গেল। মনে হল যেন সেই বিরাটকায় দৈত্য তার সামনে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছে–হে প্রভু আমার,
এবার তোমার পালা। তুমি এসো! তুমি এসো!!
ভয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন–আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। হেনরি, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!
জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি।
ক্লেরভালের শুশ্রূষায় একবার বোধহয় তাঁর জ্ঞান হয়েছিল–একটু একটু যেন মনে পড়ে। ক্লান্তি ও শান্তিতে চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল। অনেকক্ষণ পরে তিনি ঘুম থেকে উঠলেন, কিন্তু বড় দুর্বল বোধ করতে লাগলেন।
আচ্ছন্ন অচেতনতায় এরপর কেটে গেল কয়েকটি সংজ্ঞাহীন দিন–এক নিঃসীম তুষার-মরুর ভেতর দিয়ে তিনি যেন চলেছেন রাত্রিদিন নিঃসঙ্গ, একাকী। কোনোদিন আর বোধহয় সেই মরুভূমি পার হয়ে সবুজ মাটির সন্ধান তিনি পাবেন না; পাবেন না তিনি আর কোনো পরিচিত মুখের দেখা। নির্জন নিম্পাদপ তুষারের মধ্যে তার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকবে, সূর্যের ক্লান্ত রোদে তাঁর অস্থি এতটুকু উষ্ণতা বোধ করবে না।
দিনরাত রেল পড়ে রইলেন তার বন্ধুর পাশে। বন্ধুর অবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান-সাধনাকে তিনি কোনোদিনই স্বাগত জানাতে পারেননি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে দূরে এক বিজন প্রদেশে ল্যাবরেটরির মধ্যে একা একা কাজে ডুবে থাকার ফল যে শেষপর্যন্ত ভালো হতে পারে না–তা তিনি জানতেন। তবু মাঝে মাঝে তিনি এখানে এসেছেন, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন, তর্ক করেছেন, বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করেছেন–শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না-পেরে রাগ করে চলেও গেছেন। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মা’র মৃত্যুর পর সংবাদ পেয়েও যখন দেখলেন যে তিনি বাড়িতে এলেন না, তখন ক্লেরভালের রাগের আর সীমা ছিল না। কিন্তু বন্ধুর পরিবারের সকলের বেদনাকর পরিস্থিতি আর করুণ অসহায়তার কথা মনে করে তাদের ঠিকমতো কোনো ব্যবস্থা না করে বন্ধুর সঙ্গে এর শেষ মীমাংসা করার কথা ভাবতে পারেননি। প্রথমেই যখন সময় পেলেন তখনই তিনি বন্ধুর কাছে ছুটে এলেন; কিন্তু তার চিরদিনের ভয় ততদিনে ফলিষ্ণু হয়েছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের অস্থিরচিত্ততা ও অসংলগ্নতা দেখে তার ধ্রুব বিশ্বাস হল যে অত্যধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। বন্ধুর এই শোচনীয় পরিণতিতে তার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল, চোখদুটি সজল হয়ে উঠল। মনে মনে স্থির করলেন, একটু সুস্থ হলেই তাকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।