- বইয়ের নামঃ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন
- লেখকের নামঃ মেরি শেলি
- প্রকাশনাঃ প্রথমা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন
১-২. শেষরাত্রের অভিযান
অনুবাদ সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
ভূমিকা
কবি-পত্নী মিসেস মেরি ওলস্টোনক্রাফট শেলির রচনা এই প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই বইটির চিত্ররূপ সারা পৃথিবীতে যথেষ্ট সাড়া এনেছিল। মূল কাহিনী এবং চিত্ররূপ–এই দুইয়ের থেকে বেছে নিয়ে ছোটদের জন্য কাহিনীটি আমার লিখতে হয়েছে। তাই অনেকক্ষেত্রেই মূল কাহিনী কিংবা চিত্ররূপ যে অনুসৃত হয়নি, তা বলা বাহুল্য।
উইলিয়ম গডউইনের মেয়ে মেরি ওলস্টোনক্রাফট জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট লন্ডন শহরে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি শেলি প্রথম স্ত্রী হারিয়েট ওয়েস্টব্রুকের মৃত্যুর পর মেরি শেলিকে বিবাহ করেন। তাঁর প্রথম বই ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। তার আরো কতগুলো প্রসিদ্ধ রচনা হচ্ছে : ‘ভ্যালপাৰ্গা’ (১৮২৩), ‘দি লাস্ট ম্যান’ (১৮২৬), ‘ফর্চুন অব পার্কিন ওয়ারবেক’ (১৮৩০) এবং ‘লোডোর’ (১৮৩৫)। শেলির মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইটালিতেই ছিলেন, কিন্তু পরে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। মিসেস শেলি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে মারা যান।
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ লিখতে তিনি কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার চমকপ্রদ বিবরণ মিসেস শেলি ডায়েরিতে তার স্বকীয় ভঙ্গিতে লিখে গেছেন। এক সূর্যকরোজ্জ্বল সুন্দর গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি, শেলি এবং কবি বায়রন জেনেভাতে মহানন্দে আছেন, এমন সময় ফরাসি ভাষায় অনূদিত কতগুলো জার্মান ভুতুড়ে গল্প তাদের হাতে পড়ে। ওই দুঃসহ কাল্পনিক গল্পগুলো পড়ার পর বায়রন আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন : ‘আমরাও প্রত্যেকেই এক-একটি ভূতের গল্প লিখব।’ তিনজনেই সম্মত হয়ে লিখতে শুরু করেন, কিন্তু একমাত্র মিসেস শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছাড়া আর দুজনের লেখা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেল। সঠিক জানা যায়নি যে বায়রন এবং শেলি ভূতের গল্প লিখেছিলেন কি না! ১৩৪৮-এর কার্তিক মাস থেকে এই ‘ফ্ল্যাঙ্কেনস্টাইন’ ‘মাসপয়লা’ মাসিকপত্রে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর কুলজা সাহিত্য-মন্দিরের স্বত্বাধিকারী এবং মাসপয়লা ও রবিবারের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের একান্ত আগ্রহে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৫২ সালে।
সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
.
১. শেষরাত্রের অভিযান
হিমশৈলের শীত-মন্থর আকাশে বাতাসে কেঁপে কেঁপে বাজল চারটে। শীতের শেষরাতে তখনো কেউ জেগে ওঠেনি, তখনো প্রতি গৃহের দ্বার রুদ্ধ। পাখিরা তখনো তাদের বাসায় শীতের শেষরাতের বাতাসের অলস ভাবটুকু পরম তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করছিল।
কালো গরম পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢাকা দুটি লোক খ্রিস্টিয়ানদের সমাধিক্ষেত্রের পাচিলের উপর উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে, সঙ্গে তাদের কোদাল ও শাবল। কুয়াশা ভেদ করে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, তবু তারা একবার সমাধিক্ষেত্রের দিকে ভালো করে তাকাল।
কিছু কি দেখা যায়? এই নিরন্ধ্র অন্ধকার, এই জমাট কুয়াশার আবরণ–চোখের দৃষ্টি অল্প একটু পথ অগ্রসর হয়েই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে।
কিন্তু তারা শুনেছে, আজই তাদের জীবনের পরম শুভমুহূর্ত আসবে। জীবনের পরম লগন কোরো না হেলা। আজই তাদের কাজ করা চাই। আজই…আজই….
শুধু পথ চেয়ে অপেক্ষা, রাত্রির অন্ধকারে গোপনে নিঃশব্দ প্রতীক্ষা। ঐ যে দেখা যায় দূরে কয়েকজন লোক আবছায়ার মতো স্পষ্ট করে দেখা যায় না কিছুই,
তবু–তবু তারাই হয়তো হবে। আর তবে দেরি করা চলবে না।
সেই লোকদুটি কোদাল ও শাবল মাটিতে ফেলে নিঃশব্দে লাফিয়ে পড়ল সমাধিক্ষেত্রে। তারপর আস্তে আস্তে সেই লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। চোখে তাদের হর্ষ, উদ্বেগ, ভয়।
কিছুদূরে কতগুলো লোক কবর খুঁড়ছিল। সেই লোকদুটি তাদের কাছাকাছি এসে থেমে একটু ভালোমতো জায়গা দেখে লুকিয়ে পড়ল। উদ্বেগে তাদের বুক ধুকধুক্ করছে।
প্রতি মুহূর্ত তাদের কাছে যুগ যুগ বলে মনে হচ্ছিল। এই প্রতীক্ষার কি শেষ নেই? শেষ নেই এই অনিশ্চিত সংশয়ের? এই কবর দেওয়া কি শেষ হবে না? এরা তাড়াতাড়ি হাত চালায় না কেন? এই শীতের মাঝে ওরা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে যাক, তারা নামুক তাদের কর্মক্ষেত্রে। শেষ হোক এই দীর্ঘ উদ্বেগময় প্রতীক্ষা, শুরু হোক নতুন জীবনের ছন্দময় চাঞ্চল্য।
যাক–শেষ হল তাদের কবর দেওয়া। সেই লোকদুটির এল কর্মক্ষেত্রে নামার সময়। শীতের বাতাস হাড়ের মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এখন চলছে উপাসনা : মৃতের আত্মা সুখে থাকুক। সে এ জন্মে যদি কোনো পাপ করে থাকে, মুছে যাক তা–সে নতুন আলোর সন্ধান পাক!
.
উপাসনা শেষ হলে সকলে উঠে দাঁড়াল। এবারে ফিরতি-পথ। দুঃখে, কষ্টে, শ্রান্তিতে প্রত্যেকের শরীর ভেঙে আসছে। তারা চলে গেল নিচুমুখে–নিঃশব্দে। শীতের তুহিন বাতাসের মাঝ দিয়ে দূর হতে ভেসে আসছিল তাদের সকলের সম্মিলিত জুতোর শব্দ : মচ্–মচ্।
লোকটি এবার তাদের গুপ্তস্থান হতে বেরিয়ে পড়ল। একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তারা বাঁচল। সেই শীতের মধ্যেও মানসিক উত্তেজনায় তাদের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে উঠেছে। আঙুল দিয়ে সেগুলো তারা মাটিতে ছিটিয়ে দিল।