ইসলামের আগের জামানা হতে এ-যাবত কাল পর্যন্ত বেদুঈন রমনী যে পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করে এসেছে, তা তার স্থায়ী বসুয়া বোনের ভাগ্যে ঘটে নাই। সত্য বটে, সে বহু-বিবাহ প্রধান পরিবারে বাস করে আসছে; কিন্তু তবু সে স্বাধীনভাবে স্বামী গ্রহণ করতে পারে এবং সদ্ব্যবহার না পেলে স্বাধীনভাবে স্বামী বর্জন করতে পারে।
সুযোগ পেলে মরু সন্তানেরা অন্য তমদ্দুনও অনায়াসে আত্মস্থ করতে পারে। বহুকালের ঘুমন্ত বৃত্তি উপযুক্ত সাড়া পেয়ে সহসা জেগে ওঠে এদের মাঝে এবং বিপুল শক্তিতে পরিণতি লাভ করে সৃজনশীল অর্ধচন্দ্র এই সুযোগের ক্ষেত্র। এরই প্রভাবে কোন হাম্মুরাবী ব্যাবিলনে আবির্ভূত হয়, কোন মুসাকে (আঃ) পাওয়া যায় সিনাইয়ে, কোন জেনোবীয়ার উত্থান হয় পামীরায়, কোন আরব ফিলীপ দেখা দেয় রোমে, কোন হারুনর-রশীদ জেগে ওঠ বাগদাদে। আর স্ট্রোর মত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। আজো সে স্মৃতিস্তম্ভ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে আছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তার যে অভূতপূর্ব সাফল্য, তার এক মস্ত কারণ ছিল বেদুঈনদের এই ঘুমন্ত শক্তি।
০৩. ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে
‘দ্বীপ’ হলেও আরব বহির্জগতের নজর হতে রেহাই পায় নাই। আসীরিয়ার রাজা তৃতীয় শামেনেসের কর্তৃক উত্তীর্ণ একটি লিপিতে আরবদের সম্বন্ধে প্রথম নির্ভুল উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি খৃস্টপূর্ব ৮৫৪ অব্দে দামেস্কের রাজা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে এক অভিযান করেন। এই মিত্রদের মধ্যে এক আরব শেখ ছিলেন। উত্তীর্ণ লিপির ভাষা তকালীন যুগ ধর্মেরই অনুরূপঃ কর্কর তার রাজধানী। আমি ধ্বংস করলাম। চুরমার করলাম। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেল্লাম। আরাম (দামেস্ক) অধিপতি হাদাদ-এজারের ১২০০ রথ, ১২০০ অশ্বারোহী, ২০,০০০ সৈন্য … আরব শেখ গিনদিবুর ১০০০ উট।’ এ-কথা লক্ষণীয় যে, আরবাসী সম্বন্ধে প্রথম যে ঐতিহাসিক দলীল আমরা পাই, তাতে তার সঙ্গে উটের সম্বন্ধ একান্ত ঘনিষ্ঠ।
আমরা এ যাবত আরব শব্দটি আরব-উপদ্বীপের সমস্ত বাসিন্দা সম্বন্ধেই ব্যবহার করে এসেছি ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কোন তারতম্য করি নাই। কিন্তু দক্ষিণ ও উত্তর-আরবের বাসিন্দাদের মধ্যে যে পার্থক্য, সে দিকে আমাদের নজর দিতেই হবে। মধ্য আরবের নদীগণ উত্তর-আরবের অন্তর্ভুক্ত। পথঘাটহীন মরুভূমি আরবকে উত্তর দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। দুই ভাগের বাসিন্দাদের উপর তার প্রভাব পড়েছে।
উত্তর-আরবের বাসিন্দাদের জাত-গত ঘনিষ্ঠতা ভূমধ্যসাগরীয় জাতিদের সঙ্গে; আর দক্ষিণ-আরবের জাত-গত সম্বন্ধ অ্যালপাইন জাতীয় আরমেনয়েড, হিট্টাইট বা হিব্রুদের সঙ্গে। এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : চওড়া চোয়াল, বাঁকা নাক, চ্যাপ্টা গাল ও ঘন চুল। দক্ষিণ-আরবের লোকেরাই প্রথম প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং এক নিজস্ব সভ্যতা গড়ে তোলে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগে উত্তর আরবের বাসিন্দারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয় নাই। এ পার্থক্য স্মরণ রাখা প্রয়োজন; কারণ, ইসলাম দৃশ্যত সমগ্র আরবকে একীভূত করলেও প্রকৃতপক্ষে উত্তর-দক্ষিণের মাঝখানের বিভেদ রেখা কখনো বিলুপ্ত হয় নাই। পরবর্তীকালে এর ফল বিষময় হয়েছিল এবং আরব সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে ফেলেছিল।
একটা বিশাল কীলকের মত আরব উপদ্বীপ পৃথিবীর প্রাচীনতম দুটি সংস্কৃতির বাসভূমির ভিতর অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল : একটি মিসর, অন্যটি ব্যাবিলনীয়া। আরব এদের প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারে নাই। আফ্রিকা সিনাই উপদ্বীপের কাছে এসে আরবের সঙ্গে মিশেছে। এই সিনাই উপদ্বীপেই অবস্থিত বাইবেল-খ্যাত সিনাই পর্বত। এখান হতে একটি স্থলপথ নেমে এসেছে। আর একটি এবং সেইটিই বড় রাস্তা নীলনদের কিনারা দিয়ে চলতে চলতে থিবীসের কাছে বাঁকা হয়ে লোহিত সাগরের উপকূলে এসে উপস্থিত হয়েছে। দ্বাদশ মিসরীয় বংশের আমলে খৃস্ট-পূর্ব প্রায় ২,০০০ অব্দে একটি খাল (সুয়েজের পূর্বগামী) নীলনদের পূর্ব বাহুকে লোহিত সাগরের মাথার সঙ্গে সংযুক্ত করে। প্রথমে টলেমীরা এবং পরে খলীফারা এ খালের সংস্কার করেন এবং ১৪৯৭-৯৮ অব্দে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে পৌঁছার পথ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ খাল ব্যবহৃত হতে থাকে। দক্ষিণে মাত্র ১৫ মাইল বিস্তৃত সমুদ্র অঞ্চল আফ্রিকাকে উপদ্বীপ হতে আলাদা করে রেখেছে।
প্রাক-ইসলাম যুগে আরবরা সামরিক জাতি ছিল না। তাদের ইতিহাস ছিল একটি ব্যবসায়ী জাতির ইতিহাস। দক্ষিণ-আরবে একটি সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যিক সভ্যতা বর্তমান ছিল। এই সভ্যতা আফ্রিকা আর ভারতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। উত্তর-আরব বিখ্যাত ছিল পেট্রা ও পামিলা নামক দুটি শহরের জন্য। এই দুটি বিরাট নগর সওদাগরী রাস্তার উপর নির্মিত হয়। কালক্রমে দুটিই বিধ্বস্ত ও বিচূর্ণ হয় এবং দুটিই এখন বিরাট ধ্বসং-স্কুপে পরিণত। পেট্রা শহরটি নিরেট পাহাড় কেটে তার মধ্যে হতে গড়ে তোলা হয় এবং রোমকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি ঐশ্বর্য ও উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করে। রোমক পার্থিয়ান–এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে সিরিয়ার মরুভূমিতে পামীরা শহর অবস্থিত ছিল। পামীরার উচ্চাভিলাসিনী অনিন্দসুন্দরী শাসনকর্মী জেনোৰীয়ার কথা দুনিয়া আজো ভোলে নাই। তিনি নিজে নিজেই ‘প্রাচ্যের রাণী উপাধী গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্যের সীমা বাড়িয়ে বাড়িয়ে তাতে মিসর ও এশিয়া-মাইনরের এক বিরাট অংশ শামিল করে নিয়েছিলেন। ২৭২ খৃস্টাব্দে যখন ম্রাট আরেলীয়ান জেনোবীয়ার সেনাপতিগণকে পরাজিত করলেন, তখন রাণী এক দ্রুতগামী উটের পিঠে চড়ে পালিয়ে মরুভূমিতে চলে গেলেন। কিন্তু রোমের বিপুল শক্তির সামনে তিনি মরুভূমিতেও নিরাপদ রইলেন না। সেকালের রীতি অনুসারে তাঁকে এই সম্মান করা হল, বিজয়ী বীর যখন জাকজমকপূর্ণ উৎসবের ভিতর দিয়ে রোমে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁকে সোনার শিকলে বিজয়ীর রথের সামনে বেঁধে নেওয়া হল।